আদরের ভাইটিকে বলছি

আদরের ভাইটিকে বলছি-Miftahul-Uloom
আদরের ভাইটিকে বলছি

আদরের ভাইটিকে বলছি

আদরের ভাইটিকে বলছি

( দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের আলোকিত পরশে দ্বীন পাওয়া প্রতিটি কলেজ বা ভার্সিটির জেনারেল শিক্ষিত ছাত্র ভাইয়ের কমন দ্বীনি সমস্যাগুলোতে করণীয় কি এ ব্যাপারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আকাবিরগনের মুজাকারার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা)

 

প্রিয় ভাই,

তোমার বড় সৌভাগ্য তোমার সোনালী ছাত্রজীবনেই দাওয়াতের কাজের মতো এক হীরার টুকরো মেহনতের সন্ধান পেয়েছো। তুমি এ নিয়ামতের কদর করো। আমিও তোমার মতো এই পথেরই পথিক। ছাত্রজীবনের প্রারম্ভে রাব্বে কারীম আমাকেও নসীব করেছিলেন এই মেহনতে জুড়ার।আজ আল্লাহর মেহেরবানিতে প্রায় উনিশ বছর হয়ে চললো আমার এই পথচলা।

এই বিপদসংকুল পথের বাঁকগুলো অতিক্রম করে এসেছি বলে রাস্তার হাল হাকীকত কিছুটা হলেও চেনা। আমার এই লিখা যদিও তোমাকে সম্মোধন করে লিখছি, বাস্তবে সম্মোধিতদের মাঝে আমিও আছি। কারন আমাকে এই মেহনত মুহতাজ হয়ে চলতে শিখিয়েছে। এই মেহনতে প্রতিটি কথা বলা, প্রতিটি কথা শুনা, এই রাস্তায় প্রতিটি কদম, প্রতিটি সফর নিজেকে সামনে রেখে।

من جاهد فإنما يجاهد لنفسه.

যে সাধনা করে, সে নিজের জন্যেই সাধনা করে।

ভাই, তোমার সেই অতীতের কথা কি মনে পড়ে, যেদিন তুমি দ্বীন থেকে গাফেল ছিলে? যেদিন মসজিদে আযান হতো, অথচ মসজিদে না যাওয়ার কারনে তোমার মনে কোন আফসোস অনুভূত হতো না? 

আজ এই মেহনতের বরকতে তুমি তোমাকে চিনেছ। নিজেকে এখন তোমার মুনাফিক মনে হয়। নিজের অনেক মন্দ বিষয়ের কথা ভেবে তুমি পেরেশান হও। নিজেকে দ্বীনের ক্ষেত্রে আরও  অগ্রসর করাতে পারছো না বলে তোমার আফসোস হয়। হয়তো অনেক সময় তুমি ইহাও ভাবো, তাবলীগের কাজ করে তোমার আর ইসলাহ হচ্ছে না। কখনও কখনও নিজের উপর পেরেশান হয়ে ইসলাহের জন্য অন্য কোন পথ বা মতও তুমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকো।

অথচ তুমি একটু খেয়াল করে দেখো তো, যখন তুমি ঠিকমতো নামাজও পড়তে না, তখনও নিজের ইসলাহের জন্য কোন আফসোস তোমার মনে আসতো না। তুমি শোকরিয়া আদায় করো, এই যে নিজের মধ্যে দূর্বলতা অনুভব করা ইহাই ঈমানের আলামত। ক্রমাগত দাওয়াতের মেহনত করার বরকতেই এই নূর তোমার মাঝে তৈরি হয়েছে। অথচ শয়তান তোমাকে এই বলে ধোকা দিচ্ছে এই মেহনত করে তোমার আর অগ্রগতি হচ্ছে না।

তুমি কি জানো, মাত্র কিছুদিন কাজে না জুড়লে এই আফসোসটুকুও তোমার থাকবে না? তোমার অগ্রগতি হয়তো তুমি বুঝতে পারছো না। মেহনত না করলে যে দ্রুত পতন হয় তা কিন্তু সহজে বুঝা যায়। তাহলে বুঝে নাও, দুদিন কাজে না জুড়লেই যখন তোমার অধঃপতন হয়, নিঃসন্দেহে প্রতিদিনের মেহনতের দ্বারা তোমার উন্নতি হচ্ছে,  যদিও তা তুমি অনুভব করতে পারছো না। মনে রেখ, নিজের উন্নতি উপলদ্ধি করতে না পারা এটিও একটি নিয়ামত। আমাদের রব আমাদের হেফাজতের জন্যই অনেক সময় আমাদের উপলদ্ধির উপর পর্দা ঢেলে দেন, যেন মন অহংকারী হয়ে না উঠে।

মেহনত যখন সহীহ হয়, তখন নিজের ইসলাহের ফিকর অন্তরে বজায় থাকে। আর যখন মেহনত গলদ হয়, নিজেকে পরিশুদ্ধ মনে হতে থাকে। তোমার যেহেতু নিজের উপর আফসোস হচ্ছে, শোকরিয়া আদায় করো, এক হক মেহনতের সাথে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সহীহভাবে জুড়ার তৌফীক দিয়েছেন। সুতরাং এই মেহনত যখন তোমাকে তোমার দূর্বলতা ধরিয়ে দিচ্ছে, ইয়াকীন করো, সে দূর্বলতা এই মেহনত করতে করতেই দূর হবে ইন শা আল্লাহ। তবে এখন থেকেই কোন আলিমে রব্বানী, যার কাছে দাওয়াতের মেহনতের সত্যতা স্পষ্ট, তেমন কারও পরামর্শে চলতে শুরু করো, তাহলে ইন শা আল্লাহ রাস্তা ভুল হবে না।

প্রিয় ভাই,

গতকাল আলোচনা করছিলাম মেহনতের মাধ্যমে নিজের তরক্কী অনুভূত না হওয়ার কারন প্রসংগে। বলছিলাম, অনেক সময় আল্লাহ তায়ালাই আমাদের হেফাজতের জন্য তরক্কীর উপর পর্দা ঢেলে দেন। তরক্কী অনুভূত না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো, একজন সাথী যখন প্রথম কাজে লাগে, সে তো একপ্রকার শুন্য থেকে শুরু করে। আগে নামাজ পড়া হতো না, এখন নামাজ পড়া হয়। আগে দাঁড়ি ছিল না, এখন মা শা আল্লাহ সুন্দর দাঁড়ি এসেছে। আগে গুনাহকে গুনাহই মনে হতো না, এখন মা শা আল্লাহ গুনাহ থেকে বাঁচার তৌফীক হয়। তো, প্রথম দিকের আগে বাড়া ছিলো এমন যেমন একটা খালি গ্লাসে পানি ভরতে থাকা। এটা তো একদম স্পষ্ট দেখা যায়, গ্লাসে ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে।কিন্তু যখন সাথী মা শা আল্লাহ মোটামুটি আমলের একটা স্ট্র্যাকচারের উপর উঠে গেছে। এরপর আগে বাড়ার যে স্টেজ শুরু হয়, সেটি হলো গুনগত দিক দিয়ে আগে বাড়া। যেমন কিনা গ্লাসভর্তি পানিকে চিনি মিশিয়ে শরবত বানানো। তো স্বাভাবিক ভাবেই পানি যে শরবতে পরিণত হচ্ছে তা তো বাহির থেকে দেখা যায় না। ঠিক এমনই গুনগত আগে বাড়াটা বাহির হতে অনুভূত হয় না। আগে ছিল কেবল নামাজী হওয়ার মেহনত, যা অনেকটা অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসার মতো। এখন হচ্ছে নামাজে খুশুখুযু পয়দা করার মেহনত। আগে ছিল আমল বাড়ানোর মেহনত, এখন চলছে আমলে ইখলাস আনার মেহনত। তো স্বাভাবিক ভাবেই গুনগত তরক্কী যেটি, সেটি হতে সময় লাগে। আর বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রথম স্টেজে উঠার জন্য যে পরিমাণ কোরবানি লাগে, দ্বিতীয় স্টেজে আগে বাড়ার জন্য আরও বেশি কোরবানি করতে হয়। আর এটিই সাধারণত বেশি হয়, কোরবানি আগের চেয়ে কমে গেছে। মেহনত অনেকটা আদত হয়ে গেছে। প্রথমদিকে নানাজন নানা কথা বলতো, ফলে দিলে আঘাত লাগতো, এখন  মানুষও আগের মতো কথার ছোবল হানে না। সর্বদিক দিয়ে কোরবানি কমে আসে। ফলে কোরবানি না বাড়ার কারনে অগ্রগতি ধীর হয়ে পড়ে। যেটাকে তুমি ভাবতে থাক, কই মেহনতের দ্বারা আর তো ইসলাহ হচ্ছে না। বাস্তবে কিন্তু এখনও আগে বাড়ছো, কিন্তু অনুভব হচ্ছে না।

আর একটা বিষয়, কেবল মেহনত এবং কুরবানিই সব নয়। বরং মেহনত হতে হবে সিলেবাস অনুযায়ী।  যে কোনভাবে মেহনত করলেই কি ডাক্তার হয়ে যায়? না। বরং সিলেবাস সঠিক হতে হয়। সিলেবাস বুঝে মেহনত, আর না বুঝে মেহনতের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। মেহনতের সিলেবাস যদি তুমি বুঝতে চাও, তোমাকে আরেকটু কষ্ট করতে হবে। হজরতজী ইলিয়াস রহঃ ও তাঁর দ্বীনি দাওয়াত কিতাবটি একটু পড়ে নাও। সিলেবাসের কিছুটা তুমি বুঝতে পারবে। আর তোমার দ্বীনি মুরুব্বী তো আছেনই, যিনি একজন আলিমে রব্বানী। খবরদার, আলিম ওলামা ও আল্লাহওয়ালাদের সোহবতের সাথে  ইলম ও আমালের মেহনত করে নি, কেবল মেহনত করেই মুরুব্বী হয়ে গেছে, এমন কাউকে কখনই পরামর্শদাতা বানাবে না। (আমার এই বাক্যটি একটু তিক্ত, বাস্তবতার কারণে কষ্ট হলেও হজম করতে হবে, আর এতেই মঙ্গল) ব্যতিক্রমও পাওয়া যায়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনই করা চাই, অনেক বিষয় সুক্ষ্ম হয়ে থাকে, ইলম ছাড়া বুঝা মুশকিল।  আর আলিমও দুনিয়াদার হলে চলবে না। বিষয়টি বেশ কঠিন এবং নাজুক।

তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মেহনত করতে পারা, আমলের উপর টিকে থাকতে পারা এটিও এক ধরনের তরক্কী।

প্রিয় ভাই,

যদিও তোমাকে উপলক্ষ বানিয়েছি, কথাগুলো আসলে নিজেকেই বলা। কারন আমি নিজেই তো সবচেয়ে বেশি মুহতাজ। আমাদের এই পাঁচকাজ মাকসাদে পৌঁছার জন্যে এক বরকতময় ওয়াসীলা। এর বরকতময় প্রভাব আমরা নিজেদের মাঝে, সাথীদের মাঝে, নতুন ও পুরাতন মুসলমানদের মাঝে বার বার প্রত্যক্ষ করেছি। তুমি নিজেও তা উপলদ্ধি করে থাকবে।

দেখো, প্রতিমাসে তিনদিন লাগিয়ে যখন তুমি ফের, সেই মূহুর্তে অন্তরে যে পবিত্রতা তুমি অনুভব কর, বলো তার কোন তুলনা হয়? কিংবা বৎসরের নিসাবী চিল্লা দিয়ে যখন ফিরতি হেদায়াত নিয়ে তুমি মারকাজ থেকে রওয়ানা করো, সেই মূহুর্তের ঈমানের স্বাদ তুমি আর কোথাও পেয়েছ? প্রতিমাসে চারটা শবগুজারী, মাসে একবার বাহাত্তর ঘন্টা একটানা দাওয়াতের ময়দানে কাটানো, মাসে টোটাল আটটা উমুমী গাশত, ষাটটি তালীম, প্রতিদিন আড়াই ঘন্টা ঈমানের দাওয়াত দেয়া, এর সাথে প্রতিদিনের তাসবীহাত ও তেলাওয়াতে যদি তোমার তরক্কী না হয়, তবে আর কোন অযীফায় তোমার উন্নতি হবে?

আমি তো মনে করি না, তোমার মতো এক ছাত্রকে কোন শায়খ এর চেয়ে শক্তিশালী কোন অযীফা দেবেন। কিন্তু তাই বলে  তুমি যেন ধোকায় পড়ে না যাও। তোমার ভুললে চলবে না, এই পাঁচকাজ মাকসাদে পৌঁছার জন্যে এক ওয়াসীলা মাত্র।তুমি যদি পাঁচকাজ করেই নবীওয়ালা কাজ করছো বলে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলো, তাহলে কিন্তু সঠিক বুঝো নি। দেখো মাকসাদে পৌঁছার অনেক রাস্তা হতে পারে। এই পাঁচকাজ মাকসাদে পৌঁছার একটি কার্যকর রাস্তা, কিন্তু একমাত্র রাস্তা নয়। কাজেই দ্বীনের উপর উঠার জন্যে আরও যত মেহনত আছে, সেগুলোকে খাটো নজরে দেখবে না। কারণ মাকসাদ হলো ইসলাহ। আর ইসলাহ চার জিনিসের নাম।

দ্বীনের গুরুত্ব অন্তরে বসে যাওয়া, শরীয়তের উপর ইস্তিকামাত হাসিল হওয়া, প্রতিটি আমলে মর্তবায়ে ইহসান অর্জন করা, প্রতিটি কাজে ইখলাস নসীব হওয়া – এ চার বস্তুর নামই ইসলাহ। মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ রহঃ তা’ই বলেছেন। তুমি যে তরিকায় মেহনত করো না কেন, তোমাকে সাধনা করতেই হবে।

لقد خلقنا الإنسان في كبد.

আমি মানুষকে সাধনা নির্ভর করে বানিয়েছি।

আল্লাহ তায়ালা এ কথা কসম খেয়ে বলেছেন। তুমি যদি মনে করো, কোন শায়খ তাঁর সীনা থেকে তোমাকে কিছু দিয়ে দেবেন আর তুমি বিনা সাধনায় অনেক উচ্চতায় পৌঁছে যাবে, তবে তুমি ভুল বুঝেছ। এক ব্যক্তি হজরত আশরাফ আলী থানবী রহঃকে বলল, হজরত, আপনার সীনা থেকে কিছু দিয়ে দিন। হাকীমুল উম্মত বললেন, আমার সীনায় কিছু কফ আছে, চাইলে নিতে পারো।

হজরত বুঝাতে চাইলেন, কিছু হাসিল করতে হলে তোমাকে সাধনা করতে হবে। বিনা সাধনায় হাসিল করার কোন শর্টকাট রাস্তা নেই।

তুমি বা আমি এখনও দাওয়াতের পথের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। মানুষ আমাদের টুপি দাঁড়ি দেখে আমাদের ব্যাপারে অনেক উঁচু ধারনা করলেও তুমি ও আমি তো জানি, আমরা কত অপরিপক্ব। এখন মাত্র মেহনত শেখার সময়। কাজেই এখন ভালভাবে এই মেহনত করতে হবে। আমরা আমাদের চিকিৎসার জন্যে দাওয়াতের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। দেখো নি, মানুষ যখন কোন হাসপাতালে ভর্তি হয় কেবল হাসপাতালের প্রেশক্রিপশনই চলে, আগের সমস্ত বিশেষজ্ঞদের ট্রিটমেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। কাজেই এই প্রেশক্রিপশন ঠিকমতো অনুসরণ করলেই কেবল আমাদের সুস্থতা আশা করা যায়।

আর তুমি যে প্রতিষ্ঠানে আছো, ঐ প্রতিষ্ঠানের হাল হাকীকত তোমার ওখানকার সিনিয়র ভাইগনই ভালো বুঝবেন। কাজেই ওখানে নিজেদের হালতের উপর যে মুজাকারা হয়, সেটিই তোমার জন্যে বেশি ইফেক্টিভ। কারন ঐ মুজাকারা কিন্তু অনেক দিনের অভিজ্ঞতার ফসল। তোমার এই প্রতিষ্ঠানের হালতের উপর যুগ যুগ ধরে তোমার সিনিয়রগন যেভাবে মেহনত করেছেন তার সারাংশই তোমার সামনে পেশ করা হয়। এ কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুরুব্বীও যিনি এখানকার হালত সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন, তিনিও তোমার জন্যে এর চেয়ে ভাল প্রেশক্রিপশন দিতে পারবেন না।

তুমি তোমার প্রতিষ্ঠানের জামাতের পরামর্শে চলতে থাকো। তুমি এই পরামর্শে না চললেও হোচট খাওয়ার সম্ভাবনা। কারন জামাতের সাথে থাকা রহমত, জামাত থেকে আলাদা হওয়া আযাব। তাই বুঝে বুঝে তুমি সাবধানে চলো। একা চলতে গেলেই তুমি পথ হারাবে।

প্রিয় ভাই, এটি তোমাকে লিখা আমার চতুর্থ পোস্ট। আমি জানি, এক বৈরী পরিবেশে তুমি দ্বীনের উপর চলার চেষ্টা কর। একজন মাদ্রাসা ছাত্র কখনও তোমার এ মুজাহাদা কল্পনা করতে পারবে না। সবার চেয়ে ভিন্ন পোষাকে, ভিন্ন অবয়বে এখানে তোমাকে চলতে হয়। তাই বলে তুমি কি নিজেকে আনস্মার্ট ভাবো?

নিশ্চয় তুমি নতুন ফ্যাশনের শার্ট গায়ে দেয়া, প্রতিদিন শেভ করে নিজের চেহারাকে মসৃন করে রাখা, আর হাল ফ্যাশনের স্টাইলিশ চুল রাখাকে স্মার্টনেস ভাবো না। প্রথম যেদিন তিনদিন লাগিয়েছ সেদিনই তো তোমার ভুল ভাঙ্গার কথা। যে তার রবের সামনে দাঁড়াতে জানে, সেই তো স্মার্ট।

তোমার বাতাসে উড়ে যাওয়া পাগড়ির শামলা, তোমার লম্বা জামা, তোমার চেহারার নূরানী দাঁড়ি, তোমার অবনত দৃষ্টি কতজনকে যে প্রভাবিত করে তুমি জানো না। এই যে পৃথিবীর মিথ্যা জৌলুসকে বুড়োে আঙ্গুল দেখিয়ে তোমার সুন্নাহর রঙে রঙিন হওয়া, তা অনেক দিলেই আফসোসের রক্তক্ষরণ ঘটায়। এক গাফেল পরিবেশে এই যে তোমার ফিকরমান্দ চলা, এ তো অনলাইনের হাজারো ইসলামিস্টের কলম জিহাদের চেয়ে লক্ষগুন শক্তিশালী।

তোমার যে বন্ধুকে ডাকলে এখনও মসজিদে আসে না,  তার অন্তরেও তোমার জন্যে বিশাল ইজ্জত। আমার বাল্যবন্ধুদের কয়েকজন চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। আল্লাহর রাস্তায় সময় লাগানোর সুযোগ তখনও তাদের হয় নি। তো তারা আমাকে প্রায়ই বলতো, ভার্সিটিতে যখন দু’পক্ষের মাঝে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়, আমরা তালাশ করতে থাকি, তাবলীগের ভাইয়েরা কোন পথে যাচ্ছে। আমরা তাদের পিছু নিই। আমাদের বিশ্বাস, বন্দুকের গুলি সে পথে যাবে না।

দেখো, তোমার ব্যাপারে তোমার দ্বীনবিমুখ ভাইদের কি ধারনা! অতএব, কখনোই হীনমন্যতায় ভূগো না। নিজেকে ছোট ভেবে চলো না। বরং এই ক্যাম্পাসে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে ভেবে আনন্দিত হও। তোমার হাসিমুখে একটা সালাম, তোমার একটু মুসাফাহা কত অন্তরে যে আফসোস জাগাবে তার শেষ নেই। প্রতিদিনের একটা সালামও কারও না কারও দিল ঘুরিয়ে দিতে পারে। আরে আমি বাড়িয়ে বলছি না। এর পক্ষে কত কারগুজারি যে আছে কি বলবো।

নিজেকে তুমি ইমপর্টেন্ট ভাবা শেখো। এই ক্যাম্পাস বাস্তবে তোমার উপস্থিতির কারনেই নিরাপদ। নইলে অজস্র পাপের ছড়াছড়ি কত আযাব ডেকে আনতো। আল্লাহর নাফরমানির কারনে তোমার কপালের ভাঁজ, তোমার চোখের নীরব অশ্রু, হিকমতের সাথে বন্ধুকে তোমার ফেরানোর চেষ্টা, তোমার আল্লাহর জন্য ভাইয়ের প্রতি মহব্বত, তোমার শেষ রাতের নামাজ প্রতিনিয়তই শত আযাবকে ঠেকিয়ে রাখছে।

তোমাকে নববী ইফোর্টের জন্যে কবুল করা হয়েছে। এই মেহনত, সাথে কোন মুত্তাকী, পরহিজগার আলিমে রব্বানীকে রাহনুমা বানিয়ে চলাকে তোমার ইসলাহের জন্যে যথেষ্ট ভাবো। এটিই হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কাজ করা। কোরআনের ভাষায় এর নামই বাসীরাত।  হজরতজী মাওলানা ইলয়াস রহঃ একবার বলছিলেন,  ” হে ইউসুফ!  তুমি ইয়াকীন করো, কেয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সমস্ত মানুষের হেদায়াত দাওয়াতের কাজের মাঝে লুকিয়ে আছে। “

তাহলে কেন তুমি এ কথা ভাবতে যাবে, দাওয়াতের কাজের দ্বারা তোমার সংশোধন হবে না? হজরতজী আরও বলতেন, মানুষ এ জন্য আমাদের এ কাজ করতে চায় না, তারা ভাবে, তাবলীগ মানে মানুষের নামাজ শুদ্ধ করা, কালিমার আলফায শুদ্ধ করা। তারা নিজের নামাজ ও কালিমা শুদ্ধ হওয়ার কারনে নিজেকে এ কাজের অমুখাপেক্ষী ভাবে। বাস্তবে কালিমার আলফায শুদ্ধ করা, নামাজ শুদ্ধ করা তো এ কাজের আলিফ- বা- তা। বরং ঈমান ও আমালের পরিপূর্ণতার সকল দরজা এ কাজের মাঝে বিদ্যমান। মানুষ ঈমান ও আমালের যত উঁচু জায়গায় পৌঁছতে চায়, দাওয়াতের কাজের দ্বারাই তা সম্ভব। কিন্তু সাথে এই কথা সবসময় মনে রেখ, কোন আলিমে রব্বানীর রাহনুমায়ী ছাড়া তোমার চলা হবে একজন অন্ধের লাঠি ভর দিয়ে চলা। কারন তোমার যে ইলমের পূঁজি নেই।

প্রিয় ভাই, সম্বোধনেই বুঝে ফেলেছ তোমাকেই বলছি। আজ হজরতজী মাওলানা ইলয়াস রহঃ এর এক কারগুজারি তোমাকে শুনাবো। একবার এক জামাত মেহনত করে ফিরলো। তিনি হালত জানার জন্যে তাদের নিয়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, সময় লাগিয়ে কি লাভ হলো তোমাদের? সাথীদের জবাবগুলো এমনই ছিলো,

-হজরত, আগে সুরা ফাতিহাটা শুদ্ধ করে জানতাম না, এবার আলহামদুলিল্লাহ শুদ্ধ করে নিলাম।

– হজরত, খাওয়ার সুন্নতগুলো এবারই বিস্তারিত শিখলাম।

– হজরত, পর্দার গুরুত্ব আমার ছিলো না। এবার মজবুত নিয়ত করে এসেছি।

– হজরত, কামাইয়ের ব্যাপারে স্বচ্ছতা ছিল না। এবার নিয়ত করেছি প্রয়োজনে উপোস থাকবো, কিছুতেই হারাম খাবো না।

হজরতজী বললেন, আমি তোমাদের পাঠিয়েছিলাম স্বর্ণকার হওয়ার জন্যে, তোমরা সবাই অলংকার হয়ে ফিরে এসেছ।

হজরতজী এই এক বাক্যে মেহনতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় সময় দিয়ে দ্বীনদার হয়ে গেল। কিন্তু তার মধ্যে এলো না দাওয়াতের জজবা, এলো না উম্মতের দরদ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাওয়াত দেয়ার অভ্যাস তার মাঝে গড়ে উঠল না। সে যেন অলংকারে পরিণত হলো। কিন্তু তার হওয়া দরকার ছিলো স্বর্ণকার। স্বর্ণকার হাজারো অলংকার গড়তে জানে, আবার তালীম দিয়ে তৈরি করতে পারে স্বর্ণকারও। এক ব্যক্তি নিজে ইবাদতগুজার হলো। কিন্তু তার ইবাদত তো অন্যকে ইবাদতগুজার বানাবে না। যেমন অলংকারের পরশে অলংকার তৈরি হয় না। অলংকার তো গড়ে উঠে স্বর্ণকারের হাতের পরশে।

কাজেই তুমি খুব করে ভেবে দেখো, তুমি দাঈ হয়েছো কিনা। তুমি হয়তো মাসে তিনদিন লাগাও, সাপ্তাহিক গাশত তোমার মিস হয় না। শবগুজারীও নিয়মিত করো। কিন্তু তোমার মাঝে দাওয়াতের জজবা তৈরি হয় নি। কোন ভাইয়ের দেখা পেলে তাকে কৌশলে দাওয়াত দেবার জন্যে তোমার ভেতরটা হা পিত্যেশ করে না। দাওয়াত দিতে না পারলে তোমার সবকিছু বিস্বাদ ঠেকে না। দাওয়াত দেবার জন্যে তুমি বাহানার আশ্রয় নাও না। যদি তাই হয়, বুঝে নাও তুমি কেবল অলংকার হয়েছো। দাঈ তুমি হতে পারো নি।

অথচ দাওয়াতের জজবাই তোমাকে দ্বীনের ক্ষেত্রে আগে বাড়াবে। ভাল করে খেয়াল করে দেখো, যে সাথীটা তিনদিন দিয়ে দাওয়াত দিতে শুরু করেছে। সে এখনও দাঁড়ি রাখতে পারে নি, জামার মধ্যে পরিবর্তন আসে নি। গুনাহও ছাড়তে পারে নি। কোন অসুবিধে নেই। তুমি অচিরেই দেখবে, সে যে সুযোগ পেলেই দাওয়াত দেয়, এই দাওয়াতই ধীরে ধীরে তাকে বদলে দেবে। কবে যে সে দ্বীনের উপর চলা শুরু করেছে, সুন্নাহর রঙে রঙিন হয়ে গেছে সে বুঝতেই পারবে না। দাওয়াতের এমন প্রভাব। যদিও বাহ্যিকভাবে মনে হয় দাওয়াত অন্যের জন্য। বাস্তবে দাওয়াত স্বয়ং দাঈকে প্রভাবিত করে, দাঈকে ভেতর থেকে পরিবর্তন করে দেয়। দাঈকে কোন আমলের জন্য তারগীব দিতে হয় না। কোন কাজের জন্য তাশকীল করতে হয় না।

দাওয়াতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে পরোক্ষ প্রভাবই বেশি। একজন নামাজের দাওয়াত দিয়ে চলেছে। মাসের পর মাসের দাওয়াতে একজনও নামাজী হয় নি। কিন্তু দাওয়াতদাতা পাক্কা নামাজী বনে গেছে, জামাত তার ছুটে না, তাকবীরে উলা ছুটলে তার কান্না পায়। তার এ অবস্থা কেন জানো?  কেবল দাওয়াতের তা’ছীর।

কাজেই কাউকে দ্বীনের উপর তুলতে চাইলে তাকে দাওয়াতের সাথে লাগিয়ে দাও। অন্ততঃ নামাজের দাওয়াত হলেও দিক। তার বর্তমান হালতে কিছু যায় আসে না। দ্বীনের ক্ষেত্রে সে যত পিছনে হোক কোন পরওয়া নেই। কেবল তাকে দাওয়াতের উপর তোল। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। তার দাওয়াতই সবকিছু করবে। কদিন পর তুমি দেখবে সে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে।

শয়তান তোমাকে কেন রোজানা দাওয়াত দিতে দেয় না বুঝতে পেরেছো? কারন সে ভালো করে জানে, তোমাকে পথ থেকে সরানোর জন্যে দাওয়াত থেকে সরানোই কাফী। ব্যস, কোনদিন যেন তোমার দাওয়াত দেয়া না ছুটে। দাওয়াতের এই রহস্য বুঝতে পারার মাঝেই এ কাজের বাসীরাত। খুব কম মানুষের সামনেই এ রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। তবে একটি কথা, তুমি একে তাবলীগ মনে করো না, বরং তামরীন মনে করো। নিজেকে মুবাল্লিগ মনে করো না, বরং অনুশীলনকারী মনে করো। এতেই তোমার হিফাজত। অন্যথায় তুমি নিজেকে দাঈ বা মুবাল্লিগ মনে করে ধোকায় নিপতিত হবে, আর নিজেকে অনেক কিছু মনে করে আত্মগর্বের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ হিফাজত করুন।

মাওলা যেন দাওয়াতের কাজের রহস্য আমাদের সামনে সূর্যের মতো স্পষ্ট করে দেন। এ জন্য খুব চোখের পানি ঝরানো চাই।

 

প্রিয় ভাই, আমি সাধারণ একজন তাবলীগের সাথী। এই মোবারক মেহনত নিয়ে ভাবতে গিয়ে যে চিন্তাগুলো মাথায় উঁকি দেয়, সেগুলোই তোমার সাথে শেয়ার করি। গাশতে কিংবা পুরোনো সাথীদের সাথে প্রতিদিনের মুজাকারায় যে কথাগুলো বলার তৌফীক হয়, সেগুলোই তোমাকে শুনিয়ে দিই। হয়তো এভাবে বলতে গিয়ে আমার ভাবনাগুলো এক জায়গায় জমা হবে, হয়তো কারও অন্তরে ছুঁয়েও যেতে পারে কোন মুজাকারা। হয়তো নতুন করে মেহনত শুরু করে দেবেন কোন ভাই।

আমাদের সাধারনের জন্য এর চেয়ে সহজ কোন মেহনত আমি দেখি না। মাদ্রাসার তালীমের যে পদ্ধতি, ঐ পদ্ধতি এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য। সবার পক্ষে সেখানে থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। কোন শায়খের কাছ থেকে উপকৃত হওয়ার মেজাজও সবার থাকে না। যার মধ্যে ইসলাহের তলব আসে নি, সে কোন শায়খের কাছে যাওয়ার চিন্তাই করবে না। বুজুর্গানে দ্বীনের সাথে হয়তো সম্পর্ক রাখবে কেবল দুনিয়াতে বরকত পাওয়ার জন্য। ব্যবসায় বরকত হওয়ার জন্য দোয়া করানো, ছেলের পরীক্ষা ভালো হওয়ার জন্য একটু ছেলের মাথায় ফু দেওয়ানো, রোগ ভালো হওয়ার জন্য পীর সাহেবের পানিপড়া নেয়া আজকাল এসব উদ্দেশ্যেই মানুষকে বুজুর্গদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দেখা যায়। নিজের রুহানি তরক্কীর জন্য শায়খের সোহবতে যায় এমন মানুষের সংখ্যা শুন্যের কাছাকাছি। সবকিছুর মূলে কারন একটাই তলবের সমুদ্রে পানি শুকিয়ে গেছে। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে নক করা ছাড়া দ্বীনের জন্য তলব সৃষ্টি করা কঠিন। কোন মাহফিলে গিয়ে দ্বীনের কথা শুনতেও মানুষ আজ তৈরি না। এটিই বাস্তবতা। তাই নবীদের মেহনতের অনুসরণে মানুষের কাছে পৌঁছার বিকল্প নেই।

হজরতজী রহঃ তাই বলতেন, তালেবে ইলমকে ইলম শেখানো মাদ্রাসার কাজ। যার মধ্যে ইসলাহর তলব এসেছে, তাকে ইসলাহের সবক দেয়া খানকাহ’র কাজ। কিন্তু যার মধ্যে কোন তলব নেই, তার মাঝে তলব সৃষ্টি করা এটিই তাবলীগের কাজ।

যদি তলব শেষ হয়ে যায়, মাদ্রাসাগুলো পড়ানোর জন্যে ছাত্র পাবে না, খানকাহগুলো মুরীদ পাবে না। এজন্যই মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ রহঃ বলেছেন, তাবলীগ হলো উম্মুল ফারায়েজ। যদি দাওয়াতের সমুদ্রে পানি থাকে, তালীম, তাযকিয়ার সমুদ্রেও পানি থাকবে।

তাই মানুষের দরজায় পৌঁছার বিকল্প নেই। নববী দাওয়াতের এটিই বৈশিষ্ট্য। তাঁরা মানুষের কাছে যেতেন। মানুষ চেহারা ঢেকে ফেলতো, কানে আঙ্গুল দিতো, মুখ ফিরিয়ে নিত। নবীগন তারপরও যেতেন। এজন্য গিয়ে দাওয়াত দেয়াই সুন্নতের সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি। কিতাব লিখা, দ্বীনি পোস্ট দেয়া এগুলোও দাওয়াতের প্রকার। কিন্তু যার মাঝে তলব আছে, সে এগুলো পড়বে। যার মাঝে কোন তলব নেই, সে ঠিকই এড়িয়ে যাবে। আর সামনাসামনি দাওয়াত দিলে শ্রোতার রেসপন্স সহজে বুঝা যায়। দূর থেকে কিছুই আঁচ করা যায় না। তাই কাছে গিয়ে তাশকীল করা জরুরী। তাকে পরিবেশে নিয়ে আসা জরুরী। তাবলীগের সাথীরা ইহাই করে থাকে। কেবল পৌঁছে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে না। তাকে পরিবেশে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার জন্য তাশকীল করে।

তাশকীলই আমাদের মেহনতের স্বাতন্ত্র্য। তাই কেবল দাওয়াত দেয়া নয়, তাশকীলও করা চাই। সময়মতো উসুলও করা চাই। এছাড়া মেহনতের ফলাফল স্পষ্ট হবে না। মানুষ দ্বীন মানতে চায়। কিন্তু পরিবেশ তাকে সে সুযোগ দেয় না। সে দ্বীনের উপর চলতে ভয় পায়। ক্ষতির আশংকা করে। যখন সে আল্লাহর রাস্তায় এসে কিছুদিন দ্বীনের উপর চলে, তার সাহস হয়। নিজের পরিবেশেও দ্বীন মানতে হিম্মত করে। আগে যে মানুষটা নামাজ পড়তেই তৈরি ছিল না, সে এখন তাহাজ্জুদ ছুটলে কাঁদে। কেন এ পরিবর্তন? কেবলই পরিবেশে নিয়ে আসার প্রভাব।

কিন্তু এরপরও একটা কথা থেকে যায়, সেটি হলো তলব সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ। এখন কারও ইলমের তলব এলো, এখন সে ইলমের জন্য সময় দেয়, কোন আলিমের সাথে যোগাযোগ রাখে। কিংবা কারও মাঝে ইসলাহ’র তলব এলো, সে মেহনতের পাশাপাশি কোন শায়খের সাথে ইসলাহী

সম্পর্ক রাখে, এখন কি আমরা তাকে নারাজি দেখাবো, তার এজন্য সমালোচনা করবো?  তাবলীগে সব আছে বলে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করবো? যদি তাই করি, তাহলে তো তাবলীগকে একটা আলাদা দলই আমি মনে করলাম।অথচ হজরতজী বার বার বলতেন, আমরা কোন দল না, দলেরও না। বরং তাবলীগ এক মেহনতের নাম। আমরা মেহনতটিকে ঠিকমতো বুঝলাম তো! ব্যস আজ এ পর্যন্তই।

প্রিয় ভাই, আজ তোমার সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আলোচনা করবো। তোমার ইলম হাসিলের পদ্ধতি কি হবে সেটি খুবই গুরুত্ববহ প্রশ্ন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইলম হাসিলের সুযোগ তোমার হয় নি। ফলে ইলমের ক্ষেত্রে তোমার মাঝে বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তোমাকে এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে তুমি ইলম কার কাছ থেকে নেবে।

মাসায়েলে ইলমের ক্ষেত্রে আমাদের বড়গন কেবল এতটুকু বলেন, মাসায়েল ওলামায়ে কেরামের কাছে গিয়ে শিখতে হবে। মাসায়েল মানে কেবল আমলের মাসায়েল নয়, ঈমানের মাসায়েল, আখলাকের মাসায়েল। আর এ ক্ষেত্রে সময় লাগানো, না লাগানো পার্থক্য করতে যেও না। এটি আমাদের সাথীদের নতুন রোগ। কিন্তু নামেমাত্র আলেম হলেই, কিংবা কিছু মুখস্ত কোরআন হাদীস আওড়ালেই কি তুমি তাকে নির্ভরযোগ্য মনে করবে? কাজেই নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তুমি অবশ্যই হজরত মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রহঃ এর নীচের উক্তিটি সামনে রাখবে। তিনি বলতেন,

ان هذا العلم دين، فانظروا عمن تاخذوا دينكم.

নিশ্চয়ই এই ইলম হচ্ছে দ্বীন, সুতরাং তোমরা ভাল করে খেয়াল করে দেখো কার কাছ থেকে দ্বীন শিখছো।

কাজেই তোমাকে ভাল করে দেখতে হবে, এই ব্যক্তি থেকে দ্বীন শেখা আমার জন্য ঠিক হবে কিনা। প্রথম জামানায় কোন ব্যক্তির কাছ থেকে দ্বীন নেয়ার সময় দুটি জিনিস অবশ্যই দেখা হতো। দেখা হতো এই ব্যক্তি কতটুকু ন্যায়পরায়ণ, তার মাঝে তাক্বওয়া পরহেজগারি কতটুকু আছে, সে ব্যক্তিজীবনে কতটুকু দ্বীন মানে। এ বিষয়টিকে বলা হয় আদালাহ। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তারা দেখতেন, এই ব্যক্তি দ্বীনের ইলম কতটুকু সংরক্ষণ করেছে। অর্থাৎ সে যা বলছে, তা কি সে ভালভাবে জেনে বলছে। বর্তমানে দেখতে হবে, সে যা পৌঁছাচ্ছে তা সে ভাল করে রপ্ত করে তারপর বর্ণনা করছে কিনা।

তারা দেখতেন, তার এই বর্ণনা সনদের সাথে কিনা। অর্থাৎ তার এই ইলম সনদ পরম্পরায় অর্জিত কিনা। বর্তমান জামানায় দেখতে হবে, সে ব্যক্তিগত অধ্যয়নের মাধ্যমে দ্বীন শিখেছে, না নির্ভরযোগ্য উস্তাদের কাছে লম্বা সময় অতিবাহিত করে শিখেছে।

তারা এটিও দেখতেন, দ্বীনের এই ইলম তার কাছ থেকে আর কে বর্ণনা করেন। অর্থাৎ সমসাময়িক আহলে ইলমের কাছে সে নির্ভরযোগ্য কিনা।

তুমি কোন ওয়েবসাইটে ক্লিক করে কোন ইনফরমেশন পেয়ে গেলে। সাথে সাথেই তা গ্রহন করে নিলে। তুমি জানলে না, এই ওয়েবসাইটের পেছনের ব্যক্তিটি কতটুকু ন্যায়পরায়ণ, তাক্বওয়ার বিচারে সে কতটুকু উর্ত্তীর্ণ। সে আদৌ নির্ভরযোগ্য উস্তাদের সংস্রবে থেকে ইলম শিখেছে কিনা। কোন টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করতে পারাই কারও নির্ভরযোগ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। কাজেই তোমাকে দ্বীন নেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তোমার পূঁজি বড় কম। তোমার মাঝে যাচাই করার যোগ্যতা আসে নি। কোন পেইজে কোন লিখা পেয়ে গেলে, কোথাও কোন মাসআলা শুনলে, সাথে সাথে যাচাই না করে আমল করা শুরু করলে এমন যেন না হয়।

দ্বীনি কিতাব পড়ার ক্ষেত্রেও তোমাকে নীচের মূল্যবান কথাটি মনে রাখতে হবে। আল্লামা শাতেবী রহঃ তাঁর আল মুয়াফাকাত এ যথার্থই বলেছেন,

ان العلم كان في صدور الرجال ثم انتقل الي الكتب وصارت مفاتحه بايد الرجال.

ইলম ছিল ওলামাগনের সীনায় সংরক্ষিত, তারপর তা স্থানান্তরিত হলো কিতাবে,  কিন্তু তার চাবিসমুহ এখনও রয়ে গেছে ওলামাগনের হাতে।

কাজেই তুমি কখনই কিতাবকে আলিমের বিকল্প মনে করবে না। মাসায়েল অবশ্যই ওলামাগনের দরবারে সরাসরি গিয়ে হাসিল করবে। দ্বীনের ব্যাপারে কোন খটকা এলে নির্ভরযোগ্য আলিমের কাছে গিয়ে সন্দেহ দূর করে নেবে। মাসায়েল ফোনে জানার চেয়ে সরাসরি গিয়ে জানাই মুনাসিব।

মোটামুটি এ কথা পরিস্কার হতে হবে, কোন আলিমের কাছ থেকে মাসায়েল জানা যাবে, কার কাছ থেকে জানা যাবে না। কাজেই নির্ভরযোগ্য কোন মুত্তাকী, আলিমে রব্বানী, যিনি আহলুল্লাহ ওলামাগনের সোহবতে থেকে ইলম শিখেছেন, এমন কারও সাথে সম্পর্ক তৈরি করে নাও। দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে মাঝে মাঝে ওলামা হজরতগনের কাছে গিয়ে ধর্ণা দাও। কারণ তুমি ইলমের জন্য তাদের মুহতাজ। তাদের সম্মান করা ব্যতীত ইলমের ঘ্রাণ তুমি কখনও পাবে না।

ব্যস, ইলম হাসিলের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আর একটি কথা,  কখনও তোমার মাঝে এই জোশ আসতে পারে, সব ছেড়ে ছুঁড়ে কোন মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হয়ে যাই। খবরদার, বড়দের সাথে পরামর্শ ছাড়া কখনও তা করবে না। তুমি তোমার পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ইলম শিখে নিতে পারো। আর তুমি যা পড়ছো, তাও কিন্তু জরুরী, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা ফরজে কেফায়া। ভুলেও নিজের পড়াশুনাকে দুনিয়া মনে করতে যেও না। তাই এমন যেন না হয়, কোন ভুল সিদ্ধান্তের কারনে তুমি দুদিকই হারালে। তাছাড়া তোমার পরিবারের হালতও তোমার চিন্তা করতে হবে। তাদের দ্বীনের উপর উঠা কিন্তু তোমার ব্যালেন্সড মেহনতের উপর নির্ভরশীল।

প্রিয় ভাই, তুমি কি কখনও এভাবে চিন্তা করো যে, ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে কেন দ্বীন শেখার জন্যে এত কষ্ট করা, এখন কত সহজে মানুষ দ্বীন সম্পর্কে জেনে যাচ্ছে। কোন টিভি চ্যানেলের সামনে বসলে, কিংবা কোন ওয়েবসাইটে ক্লিক করলেই তো কতকিছু জানা যায়। কেন অহেতুক এত ঝামেলা করা, কেন এত কষ্ট করে ঘর ছেড়ে বের হওয়া? থাকার কষ্ট, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট!

ভাই, তুমি যদি কিছু জ্ঞান অর্জনকেই যথেষ্ট ভাবো, এটাকেই দ্বীন শেখা বুঝো, তবে তো মারাত্মক ভ্রান্তিতে তুমি নিপতিত। কোন বিষয় জেনে ফেলা, আর তা আমলে নিয়ে আসা দুটি একই জিনিস নয়। তুমি তোমার চারপাশে খেয়াল করলেই দেখবে, তোমারই পরিচিত বন্ধু তার ল্যাপটপে ঘন্টার পর ঘন্টা কোন স্কলারের লেকচার শুনে যাচ্ছে। শুধু তাই না, তোমাকে রীতিমতো এসব নিয়ে কটাক্ষপাতও করে। তোমার সেকেলে পদ্ধতির মেহনত নিয়ে হাসাহাসি করে। অথচ তুমি দেখবে, যখন মসজিদে আযান হয়, লেকচার শুনা বন্ধ করে মসজিদে যেতে তার ইচ্ছে করে না। সে ঘন্টার পর ঘন্টা তোমার সাথে বাহাস করতে রাজী হবে, কিন্তু একটু কষ্ট হবে, কিংবা মানুষ হাসাহাসি করবে অজুহাতে অনেক দ্বীনি কাজেই সে রাজী হবে না। সামান্য সুন্নতকে আঁকড়ে ধরতে তার কষ্ট লাগবে, আমল না করার জন্যে হাজারো যুক্তি সে খাড়া করবে। দেখবে তার বেশিরভাগ যুক্তি আমল না করার জন্যে।

ভালো করে বুঝে নাও, কিছু জ্ঞান হাসিল হওয়া আর হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া দুটি একই কথা নয়। তুমি দেখবে, লেখাপড়া একদম জানে না এরকম লোকও যখন মাত্র তিনটা দিন আল্লাহর রাস্তায়  দেয়, তাকে নামাজের জন্য বলতে হয় না, সে আযান হলে আর বসে থাকতে পারে না। মিসওয়াক খুঁজে না পেলে তার কষ্ট হয়, ঢিলা কুলুখ সাথে না থাকলে ইস্তিঞ্জা করতে তার কেমন কেমন লাগে। দ্বীনের যে কোন কথা সে আমলের জন্য তৈরি।  অথচ সে কোন ইসলামিক প্রোগ্রাম নিয়মিত দেখার সুযোগ পায় নি, দ্বীন সম্পর্কে লম্বা বিতর্কও সে করতে জানে না।

এই যে উভয় ধরনের মানুষের মাঝে পার্থক্য, তার কারন হলো একজন অল্প কিছু যা শিখেছে কষ্ট করে শিখেছে, এর জন্য সে মুজাহাদা করেছে। অন্যজন বিনা কষ্টে অনেককিছু জেনে গেছে ঠিক, কিন্তু তা জেনেছে আরামে আয়েশে, এসি রুমে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে।

আসলে দ্বীনের জন্য কষ্ট করা চাই, মুজাহাদা চাই। হেদায়াত পাওয়ার জন্যে নববী তরীকা চাই। এজন্যই ইমাম মালিক রহঃ যথার্থই বলেছেন,

لن يصلح اخر هذه الامة الا ما اصلح اولها.

এই উম্মতের শেষ অংশের সংশোধন হবে না ঐ জিনিস ব্যতীত,যা সংশোধন ঘটিয়েছে উম্মতের প্রথম অংশের।

যতই তুমি বলো এখন আধুনিক যুগ, সেকেলে পদ্ধতি এখন বেকার, কেন এই ইন্টারনেটের যুগে এত কষ্ট করা,  বাস্তবে মেহনত ছাড়া হেদায়াত আসবে না। তুমি হয়তো অনেক জানবে,  কিন্তু আমল করতে পারবে খুব কম। আমলের যোগ্যতা সে ভিন্ন জিনিস। হেদায়াত পাওয়ার জন্যে কষ্ট করা লাগবে। যুগ ডিজিটাল হলে কি হবে সুন্নাতুল্লাহর তো পরিবর্তন ঘটে নি।

এ আয়াত তো মানসুখ হয়ে যায় নি,

والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا.

আমার রাস্তায় যে মুজাহাদা করবে, নিশ্চয়ই হেদায়াতের রাস্তাসমুহ আমি তার জন্যে খুলে দেবো।

মেহনত মুজাহাদাই হেদায়াতের রাজপথ। এজন্য তুমি কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের দেখো, সে দ্বীন শেখার জন্যে কত কষ্ট করে। ফলে দ্বীনের উপর চলা তার স্বভাবে পরিণত হয়। তার জিন্দেগীই দ্বীন বনে যায়। অথচ কোরআন হাদীসের উপর এই পড়াশুনা আরও অনেক জায়গায় হয়, কিন্তু সে দ্বীনদারী তাদের মাঝে পাওয়া যায় না।

মসজিদে তালীমের হালকায় তোমার দশ মিনিট বসতে ইচ্ছে করবে না, কিন্তু কোন টিভি চ্যানেল, কিংবা ল্যাপটপে ডাউনলোড করা স্কলারের লেকচার ঘন্টার পর ঘন্টা শুনলেও মন বিদ্রোহী হবে না। আসলে যেখানে নফস মজা পায়, সেখানে হেদায়াত অনেক দূরের বস্তু। আর যেখানে নফসের দলন হয়, সেখানেই এতেআ’তের বীজ রোপিত হয়।

হেদায়াত পেতে হলে মুজাহাদার রাজপথে নামতে হবে। কারণ এটাই সুন্নাতুল্লাহ।

ولن تجد لسنة الله تبديلا.

তুমি আল্লাহ তায়ালার সুন্নত বা নিয়মের মধ্যে কোন পরিবর্তন পাবে না।

কাজেই কেন অহেতুক এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরানো, মজবুতির সাথে ধরে থাকি এই হীরের টুকরো মেহনত। এর সাথে অবশ্যই কোন আলিমে রব্বানীর সাথে নিবিড় যোগাযোগ। তবেই তো তোমার জন্যে খুলে যাবে সৌভাগ্যের আসমানী দুয়ার।

প্রিয় ভাই, কখনও কি এমনও হয় তুমি রিয়ার ভয়ে আমল করা ছেড়ে দাও? আজ ঠিক করেছি এ ব্যাপারেই বলবো।

নিশ্চয়ই ইখলাস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা গুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ইখলাসকেই ঈমান বলেছেন। ইখলাস হাসিলের জন্য তাই সবসময়ই চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ইখলাস নেই মনে করে আমল ছেড়ে দেয়া কখনোই ঠিক নয়। এ ব্যাপারে এক বুজুর্গ খুব সুন্দর বলেছেন। সম্ভবত হজরত হাজী ইমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহঃ কথাটি বলেছিলেন।

তিনি বলেন, মানুষ যখন কোন আমল শুরু করে তা রিয়াই হয়। কিন্তু যদি তা করতে থাকে, করতে থাকে, সেটি আদত বা অভ্যাসে পরিণত হয়। এরপরও তা ছেড়ে না দিয়ে যখন নিয়মিতভাবে করে, সেটি ইবাদতে পরিণত হয়। এরপরও যখন সে আমলটি ছেড়ে দেয় না, নিয়মিত করতে থাকে, সেটি ইখলাসে পরিণত হয়। কাজেই কেউ যদি প্রথম দিনই রিয়ার ভয়ে আমল ছেড়ে দেয়, সে তো কোনদিনই ইখলাসের নাগাল পাবে না।

কাজেই যখন শয়তান বুঝায়, আরে তুমি তো রিয়াকার,  তোমার আমলে কি হবে! তখন নিজেকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা, আমি যে রিয়াকার তা তো আমি জানিই। মুখলিস হওয়ার জন্যেই তো আমি আমল করে যাচ্ছি। আমার মাঝে ইখলাস নেই বলে কি আমল করবো না? আজ বরং রিয়ার সাথেই করি।

এরপর যখনই কোন আমল শুরু করি, নিজেকে শুধাই, কেন তুমি এ আমল করছো?  মানুষকে দেখানোর জন্যে? কিন্তু তুমি যেমন ফকির, সেও তো ফকির, সে তোমাকে এর কি বিনিময় দিতে পারবে?

তুমি কি রাস্তায় পাশাপাশি ভিক্ষায় রত দুই ফকিরকে দেখো নি? তারা কিন্তু কখনোই এ আশা করে না, পাশের ভিক্ষুক তার প্লেটে কিছু দেবে। কাজেই বোকার মতো অন্যকে দেখানোর জন্যে আমল করে কি লাভ!

হজরতজী মাওলানা ইউসুফ রহঃ বলতেন, ” প্রতিটি আমলের শেষে এ জন্য ইস্তিগফার করা, আমি আমলটি ইখলাসের সাথে করতে পারি নি। ইসতিগফারের বদৌলতে একদিন আল্লাহ তায়ালা ইখলাস দিয়ে দেবেন।

প্রতিদিন কিছু আমল গোপনেও করা চাই, যেন আল্লাহ ও ফেরেস্তা ছাড়া আর কেউ না জানে। তুমি হজরত ইমাম জয়নাল আবেদীন রহঃ এর কথা কি তালীমে শুনো নি? তার সাহায্যে ত্রিশটা পরিবারের ভরণপোষণ চলতো। অথচ তা প্রকাশ হলো যখন তিনি মারা গেলেন। তাঁর জীবদ্দশায় কেউ তা জানলো না। হেদায়ার গ্রন্থাকার হেদায়া কিতাবটি লিখেছেন দীর্ঘ তের বছরে। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রতিদিন রোযা রেখেছেন। অথচ তাঁর খাদেমও তা জানতে পারে নি। খাদেম দিনের বেলা খাবার নিয়ে আসলে রেখে যেতে বলতেন। খাদেম চলে গেলে সে খাবার কোন ছাত্রকে খাইয়ে দিতেন। খাদেম যখন পাত্র ফেরত নিতে আসতো, খালি পেয়ে  মনে করতো তিনিই খেয়ে নিয়েছেন।

কাজেই তুমিও কিছু আমল গোপনে করার অভ্যাস বানাও। অন্য আমলে ইখলাস না থাকলেও এই আমলগুলোতে নিশ্চয়ই ইখলাস থাকবে।

নিজেকে কখনোই মুখলিস মনে করতে যেও না। নিজের গুনের মাঝেও দোষ তালাশ করতে থাকো। আর অন্যকে সবসময়ই মুখলিস জ্ঞান করতে থাকো। ভুলেও কারও ইখলাসের ব্যাপারে খারাপ ধারনা করো না। ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহঃ এর এক ঘটনা মশহুর আছে। একবার ছয়মাস তিনি তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন নি। এর কারণ তালাশ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এক ব্যক্তিকে রোনাজারি করতে দেখে তিনি মনে করেছিলেন, মানুষকে দেখানোর জন্যে কাঁদছে। এরপর তিনি যখন তাওবা করলেন, আল্লাহ তায়ালা আবার আমলের তৌফীক দিয়েছিলেন।

আসলে কোন মুমিন কখনোই লোকদেখানো কোন আমল করে না। শুরুতে ইখলাসের সাথেই সে আমল শুরু করে । কিন্তু শয়তান তার নিয়তকে নষ্ট করার জন্যে ওয়াসওয়াসা ঢালতে থাকে। আমাকে শয়তানের এ কারসাজির ব্যাপারে সাবধান হতে হবে।

ইখলাসের জন্যে চাই বুজুর্গানে দ্বীনের জুতা সোজা করা। চলতি জামাতে প্রতিটি সাথীকে আল্লাহর নেক বান্দা জ্ঞান করে তাদের খেদমত করতে থাকা চাই। এমন কিছু কাজ থাকে যেগুলো নফস করতে চায় না। যেমন টয়লেট পরিস্কার করা, মসজিদ ঝাড়ু দেয়া, ইজতেমায়ী সামানা বহন করা। এ কাজগুলো নিজের ইসলাহর নিয়তে করতে থাকবো যেন দয়া করে রাব্বে কারীম আমাকে ইখলাস দিয়ে দেন।

আর চোখের পানি তো আছেই। দ্বীনের ক্ষেত্রে যার কোন বিকল্প নেই। আমার সমস্ত মেহনত বেকার হবে যদি তিনি দয়া না করেন।

ব্যস, এই কথাগুলো বার বার অন্যদের সাথে মুজাকারা করা চাই। আমাদের বড়গন বলেন, যে আমলের উপর উঠতে হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর লাগবে তার আলোচনাও আজকে থেকে শুরু করা যেন তার উপর উঠা সহজ হয়।

১০

প্রিয় ভাই, দ্বীনের উপর চলতে গিয়ে কখনও যেন তোমার মাঝে নিজের পড়াশুনাকে তুচ্ছজ্ঞান করার মানসিকতা তৈরি না হয়। শয়তান অনেক সময় দ্বীনদার শ্রেণীকে তার দুনিয়ার প্রতি বেশি বিতৃষ্ণ করে তুলতে চায়। জায়েজ দুনিয়ার প্রতি ঘৃণা তৈরি করে তাকে জাগতিক ব্যাপারে উদাসীন করে তুলে। দুনিয়ার ক্ষতি করিয়ে তাকে দ্বীন থেকে সরানোর কৌশল হিসেবে শয়তান তা করে থাকে। যখন এক সময় সে দেখে দুনিয়ার ক্ষেত্রে বেশি পিছিয়ে গেছে, তার মধ্যে দুনিয়া হাসিলের জেদ চেপে বসে। ফলে সে দ্বীন থেকে গাফেল হয়ে যায়। মেহনত করতে গিয়ে যখন তোমার মনে এ খেয়াল আসে, পড়াশুনা বেশি করে কি লাভ, কোনভাবে পাশ করলেই তো চলে, বুঝে নাও, শয়তান তোমাকে নিয়ে খেলছে।

নিজের পড়াশুনাকে কখনোই তুচ্ছজ্ঞান করতে যেও না। দুনিয়াবী জ্ঞান বিজ্ঞান হাসিল করা কখনোই দ্বীনদারীর পরিপন্থী নয়। বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

الحكمة ضالة المؤمن أني وجدها فهو أحق بها.

জ্ঞানবিজ্ঞান মু’মিনের হারানো সম্পদ, যেখানেই তা পাওয়া যাবে, মু’মিনই এর সবচেয়ে বেশি হকদার।

কাজেই কখনোই তুমি এ কথা ভেবো না, তোমার এই ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি পড়া, তোমার এই মেডিকেল সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া দুনিয়া। বরং তুমি তোমার এই পড়াশুনাকে আখিরাত বানাও।

আমরা বোকার মতো একটাকে মনে করি দুনিয়া, আর একটাকে মনে করি আখিরাত। অথচ মু’মিনের সবই তো আখিরাত, সে এমন কিছু করতে পারে না, যা আখিরাতে কাজে আসবে না। যে নিয়ত করতে জানে, তার জন্য মুবাহ কাজও নেকীর কারন হয়ে যায়।

কাজেই তুমি যেন তোমার পড়াশুনাকেও দাওয়াত বানিয়ে নাও।

একবার আমাদের হোস্টেলে ঢাকা মেডিকেলের এক সিনিয়র জামাতে এসেছিলেন। তিনি আমাদের সাথে মুজাকারার সময় বললেন, ” ছাত্রদের জন্য পড়াশুনাকে গুছিয়ে রাখা এমন, যেমন সাহাবাগন আল্লাহর রাস্তায় যাওয়ার জন্যে নিজেদের ঘোড়া, নিজেদের হাতিয়ার ইত্যাদি রেডি করে রাখতেন। ঘোড়াকে ভাল মতো খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করে রাখতেন, যেন জিহাদের ডাক এলে সওয়ার হয়ে যেতে পারেন।” তো তিনি বললেন, ছাত্রদের জন্য পড়াশুনাটা যেন সওয়ারী। পড়াশুনা গোছানো থাকবে, দ্বীনের যেকোন তাকাজা সে সহজে পূরণ করতে পারবে। পড়াশুনা রেডি না থাকলে তার জন্য তা সহজ হবে না।

কাজেই তোমার পড়াশুনা তোমার মেহনতেরই অংশ, কখনো নিছক দুনিয়া নয়।

মেহনতের কথা ভেবে সবাইকে গন হারে ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ দেয়া মোটেই ঠিক নয়। যারা ইসলামকে কেবল ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ ভাবে, তারাইই এই ভুলগুলো করে থাকে। ইসলাম তো সমষ্টিগত জীবনকেও সুন্দর করার কথা ভাবে। যোগ্য, মুত্তাকী, দক্ষ লোক যথোপযুক্ত স্থানে না থাকা বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের ভোগান্তির অন্যতম কারণ। যারা আবার ইসলামকে পূর্ণবিজয়ী দেখার স্বপ্নে বিভোর, তারা জ্ঞানচর্চার কোন ক্ষেত্রকে খাটো চোখে দেখতে পারে না।

কাজেই তোমার ভালভাবে পড়াশুনা করাটাকেও তুমি ইসলামের অগ্রযাত্রায় একটা পদক্ষেপ হিসেবে দেখো। তোমার অবহেলার সুযোগ নিয়ে কোন দুষ্টলোক বিভিন্ন পজিশনে পৌঁছে জাতির ক্ষতি করবে, তা তো হতে দেয়া যায় না।

১১

প্রিয় ভাই, আজকের আলোচনাটি কালকের মুজাকারারই ধারাবাহিকতা।পড়াশুনার ক্ষেত্রে কেন কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না সে ব্যাপারেই আলোচনা হয়েছে গতকাল। শয়তান যে যুক্তি দিয়ে পড়াশুনায় বিঘ্ন ঘটায়, সে ধরনের আর কিছু খোঁড়া যুক্তি দিয়ে পেশাগত জীবনেও সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক ভাইকে দেখা যায়, হালাল উপার্জনে অলসতা করে।যদি তাকে বলা হয়, ভাই ব্যবসা করো,  সে বলে, মহিলা কাস্টমারদের সাথে লেনদেন করবো কিভাবে? চাকরীর কথা বললে মহিলা স্টাফের উপস্থিতিতে নজরের হেফাজতে সমস্যা হওয়ার কথা বলে। অথচ এখন সময়টা এমনই, সব জায়গায় বেপর্দা মহিলাদের সয়লাব। এখন তাই বলে কি চাকরী ব্যবসা বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে?

শরীয়তকে না বুঝার কারনেই এ সমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়। সাথীটিকে দেখা যায়, পর্দার সমস্যা হবে বলে চাকরী করতে চায় না,  এদিকে হালাল উপার্জন না করার কারনে অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় বড়ভাইয়ের কামাই খেতে থাকে, অথচ তিনি অসন্তুষ্টির সাথে তার খরচ বহন করছেন। অনেক সময় পিতার উপর বোঝা হয়ে থাকে। এভাবে তার পেটে হারাম প্রবেশ করতে থাকে। একদিকে সে সুফী, অন্যদিকে হারামভক্ষক।

সে অতিরিক্ত বুজুর্গীর কারনে হয়তো চাকরী করছে না,  কিন্তু যে সব কাজে গুনাহর সম্ভাবনা নেই যেমন, মাটিকাটা, চাষাবাদ করা ইত্যাদি কেন সে করে না? এ সব করতে আবার তার আভিজাত্যে বাধে।

আসলে বাস্তবে শয়তান তাকে ধোকা দিয়ে অকর্মন্য বানিয়ে দিচ্ছে।

শরীয়ত এ কথা বলে নি, রাস্তায় বেপর্দা মহিলার আনাগোনা, সুতরাং রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। বরং শরীয়ত বলেছে রাস্তার হক আদায় করতে, নজরকে নীচু রাখতে। এ কথা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

চাকরী আমাকে করতে হবে, কিন্তু সাথে দিতে হবে চোখের হেফাজতের পরীক্ষা। দোকানেও আমাকে বসতে হবে, সাথে করতে হবে নিজের নফসকে কঠোর নিয়ন্ত্রন।

আমাদের লম্বা সময় আল্লাহর রাস্তায় দেয়ার এটিই তো মাকসাদ। যেন আমি সর্বত্র আল্লাহ তায়ালার হুকুমকে জীবিত করতে পারি। আমি যখন চাকরীতে, ব্যবসায়, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে, হাসপাতালে, চেম্বারে নজরের হেফাজত করে চলবো, তখনই তো তা দাওয়াত হবে।

আর টাকাপয়সা খুবই জরুরী বস্তু। টাকাপয়সা জরুরত পরিমাণ কামাই করা ছাড়া দ্বীনের উপর চলা কঠিন।এ জন্য আজ থেকে কত আগে ইমাম হজরত সুফিয়ান সাওরী রহঃ বলেছেন,

আমাদের হাতে যদি দীনার দিরহাম না থাকতো, এই সব বাদশাহগন আমাদের হাতের রুমাল বানিয়ে ফেলতো।

সে যুগে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে এ যুগে কি রকম হবে? হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের রাঃ সম্পর্কে এ কথা প্রসিদ্ধ আছে, যখন তিনি দুনিয়ার কাজে মশগুল হতেন, মনে হতো এই ব্যক্তি দুনিয়া ছাড়া আর কিছু বুঝেন না। আর যখন আখিরাতের কাজে মশগুল হতেন, মনে হতো তিনি আখিরাত ছাড়া আর কিছু বুঝেন না।

অতএব তুমিও খুবই ভারসাম্য বজায় রেখে চলো। তবে ব্যবসা বানিজ্য ও চাকরীর ক্ষেত্রে অবশ্যই শরীয়তের সীমারেখা ঠিক রাখবে।

১২

প্রিয় ভাই, গত কয়েকদিন ধরেই তোমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু না কিছু লিখছি।শুনতে যদিও নসীহতের মতো শুনায়, আমি কিন্তু খুব ভাল করেই জানি তুমি কেবলই উপলক্ষ।আমার ভেতরের বেয়াড়া ‘আমিটা’র জন্যেই আসলে এত কিছু বলা।আর তোমাকে যখন দেখি প্রচন্ড প্রতিকুলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দ্বীনের উপর চলো, আমার সেই সোনালী কলেজ জীবনকেই মনে পড়ে যায়। দিল থেকে আমার মাওলার জন্যে শোকরিয়ার বৃষ্টি নামে। আমার তখন খুব ইচ্ছে করে আবার সেই অতীতে ফিরে যাই। ইচ্ছে করে, আমার সে সময়ের অসঙ্গতিগুলো ঠিক করে নিই।ইচ্ছে করে আরো সুন্দর করে সে জীবনটা আবার শুরু করি। কিন্তু মাওলা সময়কে কেবল সামনে চলার অনুমতি দিয়েছেন। তাই সে কেবল এগিয়ে চলে, পেছনে ফিরে তাকাতে সে জানে না।

অতীতকে আবার নতুন করে বিনির্মাণে আমার এ অক্ষমতায় কেবল তুমিই অবলম্বন। তাই তোমাকে সম্বোধন করে আমি নিজের আগামীকে ত্রুটিমুক্ত করতে চাই।

ভাই, আজ একটু নামাজের কথা বলি। যে কথাগুলি আমি বার বার নিজেকে শুনাতে চাই। যে রকম নামাজী হতে পারা আমার আজীবনের স্বপ্ন।

আমার দাওয়াতের কিছু অসঙ্গতিই আজ তুলে ধরি। চল্লিশ দিন তাকবীরে উলার সাথে নামাজের ফাযায়েল আছে যে হাদীসটিতে সেটির আবেদনকে ফিকে করে দেয়া নিয়ে কথা। মনে হয় অনেক সময় এভাবে দাওয়াত তুমিও দাও।

চল্লিশদিন তাকবীরে উলার সাথে নামাজ পড়লে দুটি সার্টিফিকেট- মুনাফিকদের লিস্ট থেকে নাম কাটা যাবে, নাম কাটা যাবে জাহান্নামীদের লিস্ট থেকেও।

হাদীসের মাফহুম তো এমনই। কিন্তু আমরা এ হাদীস বলি চিল্লার তাশকীল করতে গিয়ে। বলার ঢঙ্গটা অনেকটা এমন, চল্লিশদিন তাকবীরে উলার সাথে নামাজ তো এলাকায় পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় গেলে সহজ।ফলে দেখা যায়, আল্লাহর রাস্তায় গিয়ে ছত্রিশতম দিনে কারও তাকবীরে উলা মিস হলো। তার কি যে আফসোস!  কি যে কান্না!

বিশাল সৌভাগ্য হাত ফসকে ছুটে গেছে। না, আমার ইশকাল এখানে নয়। আমার অভিযোগ হলো, তাকবীরে উলার জন্যে কান্নারত এই ভাইটি যখন এলাকায় ফিরে আসে, নামাজের এই দরজার ইহতিমাম তার মাঝে আর থাকে না। বরং মাসবুক হওয়াটাই তার সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়। আর তাকবীরে উলার জন্যে তার হা পিত্যেসই বা বাকী থাকবে কেন। তার ইয়াকীনই হলো মহল্লায় এক নাগাড়ে চল্লিশদিন সম্ভব নয়। কাজেই যা অসম্ভব তার জন্য কেন বৃথা চেষ্টা করা।মানুষ তো ঐ জিনিসের জন্য চেষ্টা করে, যা হাসিল করা সম্ভব। যেটিকে আকাশের চাঁদের মতো নাগালের বাইরে মনে করে, তা ধরার চেষ্টা কোন বোকা করবে!

হজরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব রহঃ। বিখ্যাত তাবেয়ী। তিনি যয়তুন তেলের ব্যবসা করতেন। হাদীসের দরস দিতেন। মানুষের শত জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন। তারপরও এত ব্যস্ত মানুষটি দীর্ঘ বিশ বছর আযানের আগেই মসজিদ হাজির হয়েছেন। প্রতিটি নামাজ প্রথম কাতারে পড়েছেন।এই হলো নামাজের ক্ষেত্রে তাঁর ইস্তিকামাত।

বন্ধু, যদি নামাজের ক্ষেত্রেই আমি একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছতে না পারি, তো আর কোন ক্ষেত্রে আমি পারবো? আমার নামাজের অসঙ্গতিই বলে দেয় আমার দ্বীন কত অসম্পূর্ণ। ইস্তিকামাতের কিছুই আমি হাসিল করতে পারি নি।

অতএব, নামাজের ব্যাপারে আমি সিরিয়াস হই। যদি আমার তাকবীরে উলা ছুটে যায়, আমি মনে করতে থাকি আমার পেছনে একটা বাঘ লেগে গেছে। সেটি যে কোন মূহুর্তে আমার উপর হামলে পড়বে। আর যদি আমার জামাত ছুটে যায়, আমাকে মনে করতে হবে, আমার তো সব শেষ। আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। মেহনতের প্রাথমিক তাকাজাও যে আমার এখনও পুরো হয় নি।

ক্লাস বলো, আর এক্সাম বলো, কোনটাই যেন তোমার জামাতে নামাজের প্রতিবন্ধক না হয়। প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে আগাম পরামর্শ করে নিতে হবে জামাত কখন, কোথায় পড়া হবে। প্রয়োজনে পরীক্ষার হলে, কিংবা ওয়ার্ডে, অথবা ওটি রুমে।

যে নিজেকে দাঈ মনে করে, সে কি অবহেলায় জামাত তরক করতে পারে? নামাজের সময় হলে তার তো সব ভুলে যাওয়ার কথা। আযানের ডাক তো সব ছাড়ার ডাক। মাওলা তোমাকে ডাকছে। তুমি কাকে নিয়ে ব্যস্ত?

১৩

প্রিয় ভাই, আমি ভাবছি। আমি খুব করে ভাবছি। ভেবে ভেবে আমি কেবল পেরেশান হচ্ছি। তুমি পারলে আমার ব্যথাটাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করো। আর যদি তুমি তোমার আকলটাকে কাছে না লাগাও, তাহলে তুমি আমাকেও দ্বীনের শত্রুই মনে করবে। কিংবা আমাকে মনে করবে ফেতনাবাজ।

উম্মতের দ্বীনহারা মানুষ তো সে অনেক আগে থেকেই ওলামাগন থেকে বিচ্ছিন্ন। যারা একটু দ্বীনের ফিকর করতো, কিন্তু নিজেদের দ্বীনদার মনে করতো, তারাও কি ওলামাগন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে?

আমি যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবি, আমি যখন তার আলামতগুলো স্পষ্ট হতে দেখি, এর সাথে যখন রাসুলের বলে যাওয়া কথাগুলোর সাথে মিলাই, আমার আশঙ্কা বাড়তে থাকে। আমার কষ্ট বাড়তে থাকে। আমি কিছুতেই তোমাকে আমার এই কষ্টটা বুঝাতে পারবো না।

ওলামাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে হেদায়াতের সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, বিদ্যুতের মেইন সার্কিট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।

ওহীর ধারক বাহক হচ্ছেন ওলামা। তুমি যদি বুঝতে ওহী কি বস্তু। ওহীকে আল্লাহ কখনও বলেছেন রুহ, আবার কখনও বলেছেন নূর। রাসুল তার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন মুষলধারে বৃষ্টি।

রুহ থাকলে নড়াচড়া থাকে, হরকত থাকে। সারা পৃথিবী এত সুন্দর কেবল রুহের কারনে। ফুলেরা ফুটে থাকে প্রজাপতি উড়ে উড়ে যায়। চিকন লতাগুলো এঁকে বেঁকে উপরে উঠতে থাকে। এই সব আয়োজন কেবল রুহের কল্যাণে। তুমি বুঝে নাও, রুহের কি গুরুত্ব। আল্লাহ আমাদের বুঝানোর জন্যে ওহীকে বললেন রুহ, যা ছাড়া দ্বীনের এই বিশাল জগত হয়ে পড়বে স্থবির।

আমাদের মাথার উপরে সূর্য। তাই সারা পথিবী আলোকিত। যদি সূর্য না হতো, সারা পৃথিবী মানেই হতো নিকষ কালো, অথৈ অন্ধকার। তুমি যদি সূর্যের গুরুত্ব বুঝো, তাহলে তুমি সহজেই বুঝবে ওহীর গুরুত্ব।

রাসুল উদাহরণ দিলেন বৃষ্টির।মুষলধারে বৃষ্টির। যে ইলম তিনি নিয়ে এসেছেন, যে হেদায়াত তিনি নিয়ে এসেছেন, তা শাশ্বত কল্যাণ। ঠিক মুষলধারে বৃষ্টির মতো। এই বৃষ্টি থেকে কে উপকৃত হবে? রাসুল তিন ধরণের জমির উদাহরণ দিলেন। কিছু জমি এই বৃষ্টির পানি পুরোপুরি নিজের মাঝে শুষে নেয়। মৃত জমি জীবিত হয়। বাড়ে উর্বরতা, বাড়ে উৎপাদন ক্ষমতা। জন্মে প্রচুর ফসল। তাতে সে জমিরও লাভ, সবারও লাভ।

আর কিছু জমি সেই পানি জমা করে রাখে। তার লাভ না হলেও, তা অপরের উপকারে আসে। আর এক ধরণের জমি নিজেও শুষে নেয় না, অন্যের জন্যও জমা করে না। তাতে বৃষ্টির পানি পড়ামাত্রই দূরে গড়িয়ে যায়।

এই উদাহরণের মাধ্যমে রাসুল বুঝালেন মানুষও তিন প্রকার। একদলের মাঝে দ্বীনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। সে ইলম ও হেদায়াতের তালাশ করে। যেখানেই এই নিয়ামত পায়, ভাল করে রপ্ত করে নেয়। নিজেও উপকৃত হয়, অন্যকেও উপকার পৌঁছায়।

দ্বিতীয় দল ইলম জমা করে। নিজে আমল না করলেও অন্যরা তার দ্বারা উপকৃত হয়। সে ঐ মোমবাতির মতো, যে গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়।

তারা তৃতীয় দল হচ্ছে গাফেল শ্রেণীর। সে দুনিয়া নিয়ে মশগুল। দ্বীন নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই।

তুমি যদি বুঝে থাকো, এই মেহনত যা, তা কেবলই জমি তৈরীর জন্য। জমিকে প্রথম শ্রেণীর বানানোর জন্য।

মেহনত করে জমি তৈরি করলে। কিন্তু তাতে পানি সেচের ব্যবস্থা করলে না। তোমার এই মেহনত বেকার, তোমার এই সময় নষ্ট।  ঐ মেহনত পুরোই অর্থহীন যদি ওহীর সাথে তার যোগাযোগ করিয়ে দেয়া না হয়।

ওহীর শব্দ এবং অর্থ দুটোই ওলামাদের কাছে। মেহনত কেবল তলব সৃষ্টি করার। যেন ওরা ওহীর গুরুত্ব বুঝে, ওলামার কদর বুঝে।

কোন কারণে এরা যদি ওলামাবিমুখ হয়, বুঝে নাও তুমি, শয়তানের বড় সুযোগ হয়ে যাবে। অবশেষে তুমি তাকে শয়তানের হাওয়ালা করবে। গাশত-তালীমের দৌঁড়াদৌড়ি সত্ত্বেও সে মিসকীন হয়ে থাকবে।

একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন। এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো, কেয়ামত কবে হবে ইয়া রাসুলাল্লাহ। রাসুল নিজের আলোচনা শেষ করে তার প্রশ্নের জবাবে বললেন, যখন আমানতকে নষ্ট করা হবে,তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো। সে বললো, আমানতকে কিভাবে নষ্ট করা হবে? তখন আল্লাহর রাসুল বললেন, যখন অযোগ্যকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো।

ইমাম বুখারী রহঃ এই হাদীস এনেছেন কিতাবুল ইলমে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহঃ ফতহুল বারীতে এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, এই হাদীসকে কিতাবুল ইলমে আনার কারণ এই কথা বুঝানো, যখন জেহালতের প্রাধান্য হবে, ইলমকে উঠিয়ে নেয়া হবে, দ্বীনের বড়গন হবে ইলম থেকে বঞ্চিত, এরা হয়ে পড়বে অযোগ্য, ফলে দ্বীনের ক্ষতি হবে, যা কেয়ামতকে নিকটবর্তী করবে।

কালও মারকাজে এক জোয়ান সাথীর সাথে কথা হলো, সে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু করে না। মুরুব্বীর সাথে পরামর্শ করে সে মেহনতের জন্য নিজেকে ফারেগ রেখেছে। সারাদিন কি করে জিজ্ঞেস করলে বললো, মেহনতে সময় দিই,তাকাজা পূরণ করি।

বললাম, কুরআন দেখে পড়তে পারে কিনা। বললো, কেবল দশ সুরাই পারে। কোন আলিমের সাথে তায়াল্লুক আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বললো, নেই। কার সাথে পরামর্শ করে চল জিজ্ঞাসা করতেই বললো, মেহনতের ব্যাপারে অমুক মুরুব্বীর সাথে পরামর্শ করি। দ্বীনের ফরজ পর্যায়ের ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বুঝলাম, তার এ ব্যাপারে কোন আইডিয়া নেই।

এই সাথী একটা হালকার জিম্মাদার। তার পরামর্শে কত সাথী চলে। তার এই হাল। শুধু আজ আমরা একটাই বুঝি আগে বাড়ার জন্য সময় লাগাতে হবে। সময় একশতবার লাগাও,কিন্তু তোমার দ্বীনি অন্য বিষয়গুলোও দেখো। কোন আলিমের সঙ্গে তায়াল্লুক রাখো। শত শত কুরবানিওয়ালা সাথীদের হালত এই। এবং স্বাভাবিক নিয়মে ইনারাই ভবিষ্যত মুরুব্বী।

কথা প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়লো, যা কয়েকদিন আগে উস্তাদে মুহতারাম ক্বারী জহির সাহেব হুজুর শুনালেন। একবার হাটহাজারী জালাল শাহ মসজিদে একটা জামাত এলো। সেখানে মুফতিয়ে আজম ফয়জুল্লাহ রহঃকে নিয়ে যাওয়া হলো। সাথীরা হুজুরকে বয়ান করতে অনুরোধ করলো। হুজুর বিনয়ের সাথে বললেন, আমি তো ছয়নম্বরের স্টাইলে বয়ান জানি না। তবে একটা কথা মনে রাখিও, তোমরা ওলামায়ে হক্কনী এবং মাদ্রাসায়ে কাওমিয়্যার সাথে রাবেতা কায়েম রাখিও, নইলে তোমরা একটা ফিরকায় পরিণত হবে।

১৪

প্রিয় ভাই, আজ ফজরের জন্য জাগা নিয়ে বলবো। কোন কোন জুনিয়রকে প্রায় সময় বলতে শুনি, ” ভাইয়া, ফজরের নামাজের জন্য উঠতে পারি না, কি করা যায়?”

বলি, ” তুমি মজবুত নিয়ত করো, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও।অবশ্যই পারবে।”

কিছুদিন পরও দেখা যায় একই অভিযোগ, না ভাইয়া, পারছি না।প্রতিজ্ঞা তো করি, কই পারি না।”

বলি, “সমস্যা একই জায়গায় তুমি এখনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করো নি।কেন, তোমাকে যখন কোন কাজে ঢাকা যেতে হয়, খুব সকালে ট্রেনের শিডিউল থাকে, তখন তো দেখা যায় তুমি খুব সকালে উঠে গেছো, কই কোনদিন তো এমন হয় নি তুমি এই বলে আফসোস করেছ – হায়!  ঘুমের কারনে ঢাকা যেতে পারলাম না, ট্রেনটি মিস করলাম।”

এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তুমি সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়, মোবাইল কিংবা ঘড়িতে চার-পাঁচটা এলার্ম দাও, কাউকে বলে রাখো যেন সময় মতো ডেকে দেয়।অর্থাৎ তুমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও, সকালে উঠতেই হবে, এজন্য সমস্ত উপকরণকে কাজে লাগাও, কেবল নিয়ত করে বসে থাকো না।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞা কেবল নিয়ত করাকে বলে না, নিয়তের সাথে সাথে সমস্ত উপকরনকে কাজে লাগানোকে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা।

তুমি হয়তো বলবে, ট্রেনে ঢাকা যাওয়া সেটি তো একদিনের ব্যাপার, আর ফজরের নামাজ সে তো প্রতিদিনের বিষয়।

বলবো, এ ক্ষেত্রেও কষ্ট লাগবে কেবল প্রথম কয়েকটা দিন, এরপর সে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।তখন আর সকালে  নামাজের জন্য উঠা কোন ব্যাপার মনে হবে না।

কেন, রমজান মাসে কি হয় যখন সেহরী খাওয়ার জন্যে উঠা লাগে? প্রথমদিন হয়তো কেউ উঠতেই পারলো না, উপোস রোযা রাখলো, পরদিন সে সমস্ত উপকরণকে ব্যবহার করলো। কেউ তাকে না হয় ডেকে দিলো।একটু কষ্ট হলেও গতকালের কষ্টের কথা মনে করে সে ঠিকই উঠে গেলো।এরপর অভ্যাস এমনভাবে বদলে গেলো, সে এলার্ম বাজার আগেই উঠে যায়।রমজানের শেষ দিকে তো এলার্ম দেয়াও লাগে না। দেখা যায় ঈদের পরও অনেকদিন অভ্যাস তেমনই থাকে, শেষরাতে অটোমেটিক ঘুম ভেঙ্গে যায়।

আসল কথা হলো মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে ঠিকই নিজের অভ্যাসকে পাল্টাতে পারবে। প্রথম কয়েকদিন কষ্ট হবে, এরপর অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

আমি আমার অনেক রোগীকে দেখেছি, একবার বলতে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।আর অনেকে দশ বছরেও ছাড়তে পারে নি।আমার এক আত্মীয়কে দেখেছি আমাদের এত কথায়ও ওনি সিগারেট ছাড়লেন না।একবার যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সিগারেটের ক্ষতি বুঝতে পারলেন, একদিনেই ছেড়ে দিলেন। আমার যে সমস্ত রোগীকে দেখি, যারা ধীরে ধীরে কমানোর চিন্তা করে, তারা কখনও সফল হয় না।

মানুষের মন হলো শিশুর মতো। সে কোনকিছুর জন্য জেদ ধরে বসে। যখন বুঝে যে জেদ ধরলেই ঐ জিনিস পাওয়া যাবে, তখন ঐ জিনিসের জন্য কাঁদতে থাকে। আর যখন ঐ জিনিস শত কান্নার পরও দেয়া হয় না, তখন শান্ত হয়ে যায়।মনও ঠিক তদ্রুপ, যখন তার আকাঙ্খিত জিনিস পায় না, ঠিকই শান্ত হয়ে যাবে।

একটা ধনী লোক, যে ভালো ভাবার, এসিযুক্ত রুম আর ব্যক্তিগত টয়লেটে অভ্যস্ত, সে কোন কারনে জেলে গেলো। যেখানে ত্রিশজনকে এক রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে, মামুলি খাবার, সবার জন্য একটা টয়লেট,তাও কেউ গেলে সারা রুম গন্ধে ভরে যায়।

এই ভদ্রলোক হয়তো প্রথমদিন কিছুই খাবে না। কিন্তু দ্বিতীয়দিন থেকে ক্ষুধার কারনে খাবে।আস্তে আস্তে অবস্থার কারনে সবই মেনে নেবে। এক সময় দেখবে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে,আর কষ্ট লাগছে না।

এই হলো সবার অবস্থা। আমি অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য জেলে যেতে বলছি না। কেবল এটাই বলছি, মানুষ নিজের অভ্যাসকে দঢ়প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে বদলাতে পারে। নজরের হেফাজত করতে না পারা, ফিল্ম দেখা, গান শুনা ইত্যাদি সব অভ্যাসই পাল্টানো সম্ভব। শর্ত হচ্ছে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। প্রথম দুয়েকদিন কষ্ট হবে, পরে নতুন অভ্যাসেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।

 

১৫

প্রিয় ভাই, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সফলতার পেছনে দুটো বিষয় থাকে। মেহনত এবং সিলেবাস। ডাক্তার হতে গেলে কঠিন মেহনত করতে হয়। কিন্তু শুধু মেহনত করে গেলে হয় না। এর জন্যে লাগে সিলেবাস। সিলেবাস যদি যথার্থ না হয়, হাড়ভাঙ্গা মেহনত হবে  ফাটা বেলুন ফুলানোর মতো। এভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং বলি আর ব্যারিস্টারি বলি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেহনতের পাশাপাশি লাগবে সিলেবাস।

এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা রাসুল পাঠানোর পাশাপাশি পাঠিয়েছেন কিতাব। রাসুল মেহনত করেন, কিন্তু কিতাবকে সামনে রেখে, শাশ্বত সিলেবাসকে সামনে রেখে। ফলে তাড়াতাড়িই সফলতা আসে।

আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেহনত করলেন। কঠিন মেহনত। জাহেরী মেহনত, সাথে বাতেনী মেহনত। মেহনতের পরিমাণ বুঝানোর জন্য বলা হয় সব নবীর কষ্টের চেয়েও রাসুলের কষ্ট বেশি। রাসুলের মেহনত ও কুরবানির কথা আল্লাহও কুরআনে উল্লেখ করেন। হাদীসের কিতাবগুলিতেও বার বার কষ্ট ও মেহনতের বর্ণনা ঘুরে ঘুরে আসে। সাহাবাদের জবানেও তার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সফলতার বর্ণনা দেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ সাফল্যকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেন। হিদায়াতের ক্ষেত্রে বলেন,

আপনি যাকে চান হেদায়াত দিতে পারবেন না, আমি যাকে ইচ্ছে হিদায়াত দিই।

বালি নিক্ষেপের ঘটনায়ও বলেন,

আপনি নিক্ষেপ করেন নি, আমি নিক্ষেপ করেছি।

কী রহস্য এর পিছনে?

মেহনত করেন রাসুল, আল্লাহও তা স্বীকার করেন, তারপরও ফলাফল বর্ণনার ক্ষেত্রে বলেন, আপনি করেন নি, আমি করেছি।

ওলামাগন এর দুই জবাব দেন। এক, মেহনতকারী মেহনতের ফলাফলের জন্য আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ না চাইলে কোন মেহনতই সফল হয় না।

দুই, আল্লাহ যেন বলতে চান, মেহনত আপনি করলে কি হবে, সিলেবাস তো আমার। কত শতজন মেহনত করলো, কত দার্শনিক কত থিওরী দিলো, সফল হতে পারলো না। আমার সিলেবাসই তো আপনার সফলতার রহস্য।

মেহনত করতে হবে। কুরবানি করতে হবে। রাসুলকেই যেখানে করতে হলো। মেহনত লাগবেই। এটিই সুন্নাতুল্লাহ।

কিন্তু মেহনতই সব নয়। মেহনত যতই হোক, কুরবানি যাই হোক, যদি সিলেবাস সঠিক না হয়, যদি সিলেবাস নামেমাত্র থাকে, সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

রাসুল মেহনত করলেন তেইশ বছর। এরপর খুলাফায়ে রাশেদীন। হজরত ওমর রাঃ এর খিলাফতকালে দেখা গেলো অর্ধ পৃথিবী ইসলামের পতাকা তলে। হিসাব করলে দেখা যাবে, এত বড় বিপ্লব মাত্র ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরে। কারণ সঠিক মেহনত, সঠিক সিলেবাস।

মেহনতে সাধারণ মানুষ বেশি থাকে, কিন্তু তাদের পরিচালনার জন্যে চাই বিশেষ মানুষ। ইনারাই ওলামায়ে রব্বানী। তাঁরা সিলেবাস বর্ণনা করেন, সিলেবাসের অর্থ বুঝিয়ে দেন। সিলেবাসের হেফাজত করেন। সাধারণ মানুষ যত মেহনত করুক,যত কুরবানি দিক, সিলেবাসের গভীরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু তাদের মেহনতও কম নয়।

কাজেই দ্বীনের মেহনতকে এভাবে বুঝা চাই। দ্বীনের মেহনতগুলোতে ধ্বস নামে সিলেবাস বুঝে এ রকম লোক চলে যাওয়ার কারণে, কিংবা এ রকম লোকদের অবহেলা করার কারণে।

কখনও কখনও সিলেবাসের শব্দ থাকে, কিন্তু অর্থ হারিয়ে যায়। ফলে মেহনত হয়ে পড়ে রুসম রেওয়াজ।

মেহনতের সিলেবাস গভীরভাবে বুঝার জন্য থাকতে হবে কুরআন-হাদীসের গভীর বুঝ। কেউ যদি ছাত্রজীবনে কুরআন-হাদীস বুঝার মেহনতে অবহেলা করে, তবে লম্বা সময় মেহনতে দিয়েও সে সিলেবাস বুঝতে সক্ষম হয় না। ফলে বুঝের ক্ষেত্রে সাধারণের সাথে তারও খুব বেশি পার্থক্য হয় না।

আমার এই কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য, দিল মানতে না চাইলেও সত্য।

আবার মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখিখরীনের মধ্যেও বুঝের পার্থক্য হয়। আপনি হজরত ওমর পালনপুরী রহঃ এর বয়ানাতগুলো শুনুন। তিনি দেওবন্দের ফার্স্টবয় ছিলেন।ছাত্রজীবন থেকে মেহনত করছিলেন। তার বয়ান শুনুন। দেখবেন, ঈমান ও আখলাকের পরিবর্তনে সমষ্টিগত জীবনে এর প্রভাবগুলো তিনি কিভাবে তুলে ধরতেন। এ আর কিছুই না। সিলেবাসকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারার ফল।

তুমি আমার কথাগুলো নিয়ে ভাবো। আমিও ছোট মানুষ। বড়দের মুখ থেকে শুনা কথাগুলো নিয়ে ভাবি, এরপর লিখি। প্রকৃত জ্ঞানী তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই।

হে মাওলা! তুমিই বুঝ দেয়ার মালিক। আমাদের মাহরুম করো না।

১৬

প্রিয় ভাই, দ্বীনের উপর চলতে গিয়ে সতর্ক থাকা চাই, যেন আত্মগর্ব আমাকে পেয়ে না বসে। এ শয়তানের ফাঁদা মারাত্মক চোরাবালি।

 কিছু কিছু মানুষ অল্পতেই আত্মগর্বের শিকার হয়ে যায়। কিন্তু সে যে এই ব্যাধির শিকার, তা সে ধরতেই পারে না। বরং সে নিজের মনগড়া মানদন্ড দিয়ে অন্যদের মাপতে থাকে। এমন হয় কেবল নিজের পরিধি বুঝতে না পারার কারণে।

এই লোকগুলো যে খুব বেশি তা নয়। আবার যে খুব কম তাও নয়। কোন আল্লাহওয়ালার সোহবতে দ্বীনের উপর চলতে শুরু করেছে, কিংবা তাবলীগে তিনচিল্লা দিয়ে দ্বীনদার হয়েছে এমন লোকদেরই কেউ কেউ এই ভুলটা করে।

পীর সাহেব তো নির্দিষ্ট কিছু আমলই তাকে বাতলে দেন। আর তাবলীগেও নির্দিষ্ট কিছু কথাই তাকে শেখানো হয়। ছয়নম্বরের বাইরে কদম রাখার তার সুযোগই নেই। তারপরও কখনও কখনও এই ছয়নম্বরের ইলম নিয়েই সে বিশাল বিশাল গবেষণা শুরু করে। দ্বীন সম্পর্কে, দ্বীনের মেহনত সম্পর্কে, রাজনীতি সম্পর্কে, জিহাদ সম্পর্কে, আলিম-ওলামা সম্পর্কে তার নিজস্ব ইজতিহাদ চলতে থাকে। এই সুযোগে শয়তান তার অন্তরে সৃষ্টি করে নানা ভুল ধারণা। এই ওয়াসওয়াসাগুলো সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাচাই করতে পারে না।, যাচাই করার স্কেলই যে তার নেই।

কখনও কখনও এই ভুল ধারণাগুলোকেই সে মনে করতে থাকে ইলমে লাদুন্নি কিংবা নিশ্চিত জ্ঞান। সে এই ধারণাগুলোকে তাক্বওয়া কিংবা দাওয়াতের মেহনতের বদৌলতে আল্লাহর পক্ষ থেকে দান মনে করতে থাকে। কেননা ‘ জানা ইলমের উপর আমল করলে যে আল্লাহ তাকে অজানা ইলম দান করেন!’

অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। কোন আলিমকে যখন সে তার ধারণার বিপরীত কথা বলতে দেখে, তখন সে ভাবে, ‘ এখনও তাসাউফের লাইনে চলে নি তো, তাই! কিংবা এখনও সময় লাগায় নি তো, তাই!’

প্রায় ক্ষেত্রে বড় কোন আলিমও তাকে সংশোধন করতে পারেন না। সে তার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে আলিম সাহেবের বয়ানেরও খুঁত ধরতে থাকে। তাকে যে তার পীর সাহেব সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন, তাবলীগের মুরুব্বীগন যে তাকে ছয়নম্বরের বাইরে মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন, তা সে বেমালুম ভুলে যায়। বরং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে সে বিশেষজ্ঞ মত পেশ করতে থাকে। যদি সে এলাকার মুরুব্বী বা জিম্মাদার হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। তাকে সংশোধন করে কার সাধ্য!

একজন তালিবে ইলমের সাথে এমন একজনের ফোনে কথা হচ্ছিল। সে তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহ আপনাকে কেমন রেখেছেন? তালেবে ইলমটি বললো, ভাই! এভাবে বলা তো জরুরী নয়। আপনি কেমন আছেন বললেও উদ্দেশ্য পুরো হয়ে যায়। রাসুলের কাছ থেকেও আপনি কেমন আছেন পর্যন্ত প্রমানিত আছে।”

ফোনেই আলাপ চলছিলো। তালেবে ইলমটি এর বেশি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পায় নি।

এদিকে এই ভাইটি তো বিশাল চিন্তায় পড়ে গেলেন।  এ কী কথা!  আল্লাহ আপনাকে কেমন রেখেছেন বলা নাকি জরুরী নয়। হায়!  হায়! এভাবে অস্বীকার করলে ঈমান থাকে?

ভাইটি এতেই ক্ষান্ত হলো না। আলাপ করলো তারই আর দুই সাথীর সাথে। তারা বললো, সর্বনাশ!  এত বড় কথা!

সে আবার তার এক মুরুব্বীকে দায়িত্ব দিলো তালেবে ইলমটিকে হেকমতের সাথে সংশোধন করে দেয়ার জন্য। পাছে তালেবে ইলমটির বয়ান শুনে মানুষ আবার গোমরাহ হয়ে যায়! তালেবে ইলমটি যে মাঝে মাঝে গাশতে বয়ান করে! মুরুব্বীর ইসলাহী প্রক্রিয়ার কথা আর নাই শুনালাম।

এই ব্যক্তি কোন আলিমের কাছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনই মনে করলো না। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে লাগলো নিজেরাই। অথচ কোন যোগ্য আলিমকে জিজ্ঞেস করলেই কিচ্ছা খতম হয়ে যেতো।

মাসায়েলে ইলম ওলামাগনের খিদমতে গিয়ে শিখি দ্বারা কেউ কেউ বুঝে কেবল ইবাদতের মাসায়েল। অথচ দ্বীনের ব্যাপারে কোন খেয়াল অন্তরে এলেও আলিমগনের কাছে যাচাই করা উচিত। যে ডাক্তার নয়, সে তো সামান্য অসুস্থতায়ও ডাক্তারের শরণাপন্ন হবে। নইলে সে হার্টের ব্যাথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মনে করবে। অথচ তার হয়ে আছে হার্টএটাক।

কেউ কেউ আবার তালীমের কিতাব দিয়েই দলিল পেশ করে। অথচ দলিল বুঝা ও দলিল পেশ করাও কি যেই সেই কাজ!

ওলামাগনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্বীন বুঝতে যাওয়াই এ সব রোগের কারণ। কোন একজন মুত্তাকী আলিমকে মুশীর (পরামর্শদাতা)  বানিয়ে চলার মাঝেই এর সমাধান।

১৭

প্রিয় ভাই, নিজেকে মাপার একটা স্কেল থাকা দরকার। সে স্কেলটি কি? 

চিনি মুখে দিয়ে দেখলাম, তাতে মিষ্টতা নেই। কিংবা মরিচ মুখে পুরে দেখলাম, তাতে ঝাল নেই। মিষ্টতা ছাড়া চিনি, কি করে চিনি হয়? ঝাল ছাড়া মরিচ কি করে মরিচ হয়?

চিনি এবং মিষ্টতা, মরিচ এবং ঝাল একটাকে অন্যটি থেকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না। যদি এমন কখনও হয়, তাহলে বুঝতে হবে জিহ্বায় সমস্যা।

একজন দাঈ, যিনি হেদায়াতের মেহনত করেন, তার মাঝেও এমন কিছু আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরী, যা দেখে তাকে চেনা যাবে। বৈশিষ্ট্যগুলোই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলবে, ইনি দাঈ, হেদায়াতের মেহনতের সাথে আছেন। চিনি থেকে যেমন মিষ্টতা আলাদা করা যায় না, তেমনই এই বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়া একজন দাঈকে কল্পনা করা যায় না।

এই বৈশিষ্ট্যগুলোই নবী-জীবনের সারমর্ম। নবী এলেন। ঈমানের দাওয়াত দিলেন। যারা ঈমান গ্রহন করলো, তারাও এখন দাওয়াত দেন। নামাজ এখনও ফরজ হয় নি, রোযা বা যাকাতের হুকুমও এখনও আসে নি। কিন্তু প্রত্যেক নতুন মুসলমানই এক একজন দাঈ।

দাওয়াত দেন। যারা মুসলমান হয়, তাদের তালীমে বসানো হয়। দ্বারে আরকামে। কিসের তালীম হয়- ফাযায়েলে নামাজের, কিংবা ফাযায়েলে ছাদাকাতের? না!  এগুলো তো এখনও ফরজই হয় নি। তালীমে মক্কী সুরাগুলো শুনানো হয়। তাওহীদের কথা, নবীদের কাহিনী, আখলাকের কথা, সবরের কথা, আখিরাতের আলোচনা।

দাওয়াত ও তালীম। ইয়াকীন তৈরি হয় আল্লাহর যাত ও সিফাতের, আল্লাহর ওয়াদা ও ধমকির। অন্তরগুলো হুকুম মানার জন্যে তৈরি হয়।

এবার আহকাম আসে। সাহাবাগন ইবাদতের উপর জমেন। তাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে, বরকতের দরজা খুলে। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে নেয়ার যোগ্যতা আসে। ফলে আসে অন্যকে দেয়ার যোগ্যতা। অস্তিত্ব লাভ করে ইকরাম, আখলাক, খিদমত।

দাওয়াত, তালীম, ইবাদত, আখলাকের সাথে খিদমত হিদায়াতের জন্য অপরিহার্য উপাদান। যার মাঝে এ চার আমাল আসবে, সে হিদায়াত পাবে এবং তাকে দিয়ে হিদায়াত ছড়াবে। যেখানে এ চার আমাল জিন্দা হবে, সেখানেই হিদায়াতের আলো জ্বলে উঠবে।

মসজিদওয়ার জামাতের পাঁচকাজ এই চার আমাল জিন্দা করার জন্য। এ চার আমাল দিয়েই আমরা নিজেদের মাপবো, অন্যদের মাপবো। পাঁচকাজ দিয়ে নয়।

আজ আমি নিজেকে পাঁচকাজ দিয়ে মাপি, মাসিক ও বাৎসরিক খুরুজ দিয়ে মাপি। অথচ অনেক সময় এই চার আমালে আমি অনেক পিছিয়ে। ফলে আমি ধোকা খাই।

অথচ একজন দাঈ, কিংবা একজন আলিম, কিংবা একজন বুজুর্গ, যিনি তাবলীগে সময় লাগান না, কিন্তু তাঁর মাঝে এই চার আমাল আছে, তিনি হিদায়াতপ্রাপ্ত, তিনি হিদায়াতের মেহনতে আছেন। আরেকজন বছর বছর তাবলীগে সময় দিয়েও এই চার আমালে অভ্যস্ত হন নি, তিনি কিন্তু মাহরুম।

আমার নিজেকে মাপা দরকার, চিনির মিষ্টতার মতো অবিচ্ছেদ্যভাবে এই চার আমাল আমার মধ্যে আছে তো?

আছে তো আমার মাঝে দাওয়াতের ফিকর? নাকি পাঁচকাজের নামে রুটিনওয়ার্ক করি? আর মাশোয়ারার নামে নতুনদের উপর কর্তৃত্ব চালাই?

আছে তো আমার মাঝে শেখা ও শেখানোর জজবা? আমার অন্তরে আছে তো আলিম-ওলামার কদর? নাকি তিনচিল্লা দিয়েই আমি আলিমগনের সমালোচনা করি?

আছে তো আমার মাঝে ইবাদত, মুয়ামালাত ও মুয়াশারাতের পূর্ণতা,

অাছে তো আমার মাঝে আখলাক? আমি আমার ব্যবসা, চাকরি,কৃষিকাজ কিংবা শিক্ষকতাকে খিদমত বানিয়েছি তো? নাকি কেবল জামাতের রান্নাবান্নাকেই খিদমত বুঝি?

যদি উত্তর সন্তোষজনক না হয়, তাহলে সময় লাগানোর পরিমাণ, ইন্তিজামমূলক কার্যক্রম দিয়ে আমার নিজেকে বিশেষ কিছু মনে করা বোকামি। আমি তাই করছি না তো?

 

১৮

প্রিয় ভাই, নিজেকে যেমন মাপতে হয়, তেমনই কখনও অন্যকেও মাপার প্রয়োজন পড়ে। তা নিজেকে ধোকায় পড়া থেকে বাঁচানোর জন্য।

আমরা কী দেখে মানুষকে মূল্যায়ন করবো? কিভাবে মেপে দেখবো?  ইয়া বড় পাগড়ী দেখে? বিরাট একটা জুব্বা দেখে? নিঃসন্দেহে জুব্বা, পাগড়ী এগুলো পোষাকের সুন্নাহ। কিন্তু মানুষকে মাপার জন্যে, মানুষের পরহেজগারির গ্রেডিং করার জন্যে প্রথম স্কেল নয়।

আমরা বলি, মানুষকে সুন্নাহ দিয়ে মাপতে হবে। সুন্নাহই মূল্যায়নের মাপকাঠি। নিঃসন্দেহে এ-কথা সত্য। কিন্তু সুন্নাহ বললেই আমাদের নজর চলে যায় এ সব অভ্যাসগত সুন্নাহর দিকে। আরও স্পষ্টভাবে বললে, ফিকহের পরিভাষায় একটা সুন্নাহ আছে। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ, মুস্তাহাব। এই পরিভাষার সুন্নাহর দিকেই আমাদের নজর চলে যায়। অথচ কুরআন ও হাদীসে যখনই সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার কথা বলা হয়, তখন উদ্দেশ্য এই ফিকহী পরিভাষার সুন্নাহ নয়। বরং পুরো দ্বীন এতে দাখিল থাকে। ফিকহী পরিভাষায় যা ফরজ, যা ওয়াজিব সেগুলোও এই সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার মাঝে দাখিল।

কিন্তু মুশকিল হলো আমরা যখনই কোন বয়ানে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা সংক্রান্ত হাদীসগুলো আওড়াই, তার উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে বলি মিসওয়াকের কথা, পাগড়ির কথা, কিংবা ইস্তিঞ্জার  সুন্নাতের কথা । ফলে সাধারণের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। অনেক বিশিষ্টজনও ভুল বুঝেন ও বুঝাতে থাকেন। ফলে কাউকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই পাগড়ি, জুব্বা, মিসওয়াককেই মানদন্ড বানানো হয়।

অথচ কত বড় পাগড়িওয়ালা এই পাগড়ির আড়ালে বিশাল বিশাল খিয়ানত করে যায়। পাগড়ি তাকে গোপন করে, জুব্বা তাকে আড়াল করে। বড় বড় অপকর্ম করেও যথারীতি মসনদ দখলে রাখে।

অথচ মানুষের মূল্যায়ন হওয়া চাই ঈমান ও আখলাক দিয়ে। ঈমান কি দেখা যায়? হ্যাঁ, ঈমান দেখা যায়, ঈমান ধরা যায়। ঈমানের আলামত দিয়ে। ঈমানের বিপরীত নেফাকের আলামতগুলো ঈমানের অবস্থান জানিয়ে দেয়। পাগড়ি তো ঠিক আছে, দেখা চাই সে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত কি না। ওয়াদার বালাই নেই, আমানতের খিয়ানত করে, কথাবার্তায় ধূর্তামি স্পষ্ট, তারপরও তাকে বুজুর্গ মনে করা হবে?

সত্যবাদিতা, ওয়াদা রক্ষা করা, আমানতদারী এগুলো কি সুন্নাহ নয়? সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে এগুলোই তো অগ্রগন্য হবে।

ঈমানের পরে দেখতে হবে আখলাক। বদমেজাজ, হিংসুক,লোভী, অহংকারী, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকারী কি করে অনুসরণীয় হতে পারে?

এরপর অামল দেখা চাই। প্রথমেই ফরজ ওয়াজিব, পরে সুন্নাহ ও মুস্তাহাব।

আজ আমরা যা শেষে দেখতে হবে তা প্রথমে দেখে ধোকা খাই। জুব্বা -পাগড়ির দরকার নেই তা বলা হচ্ছে না। বরং আগেরগুলো ঠিক থাকলে এ গুলো তো কামাল, পরিপূর্ণতা। কামালকে অস্বীকার করা নয়।

যখন মূল্যায়নের এই মাপকাঠির অনুসরণ হবে, তখন আমরা আর ধোকার শিকার হবো না, ধোকাবাজরাও আমাদের দাওয়াত-তালীম-তাযকিয়ার মসনদগুলো দখল করে দ্বীনের বারোটা বাজাতে পারবে না।

 

১৯

প্রিয় ভাই, আজ অপ্রিয় কঠিন ব্যাধিটি নিয়েই বলি। তা হচ্ছে চোখের হেফাজত করতে না পারা। অথচ চোখের হিফাজত কেবল একটা আমল নয়, বরং যেন তা বেলায়েতের সিঁড়ি।

আকাশটা কি সুন্দর নীল, দেখলে মনটা ভরে যায়। মাঠটা যেন সবুজ কার্পেট, আহা দেখলে কি ভালো লাগে। সন্তানের চেহারাটা যেন একগুচ্ছ প্রশান্তি, মনে হয় আমার আর কিছু না থাকলেই চলে।

এই একান্ত অনুভুতিগুলি কেবলই চোখের কল্যানে। কেমন হতো যদি আমার দুটি চোখ না থাকতো! এই সুন্দর পৃথিবী তখন মনে হতো কেবলই ঘুটঘুটে কালো, এক বিশাল অন্ধকার।

পৃথিবী এতো সুন্দর, কারন আমার এক জোড়া চোখ আছে। প্রিয়জনের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, কারন চোখ তার চেহারার অভিব্যক্তিগুলো বলে দেয়। কালো গিলাফ সবুজ গম্বুজ আমাকে টানে, কারন আমার চোখ জোড়া তাতে ধন্য হবে।

মাওলা চোখ দিয়েছেন, সাথে দিয়েছেন চোখ সংযত রাখার আহকাম। চোখ মাসহাফের কালো অক্ষরগুলো পড়ে যাবে, তার জন্য নেকীর পর নেকী যোগ হবে। চোখ মায়ের চেহারায় দয়ার দৃষ্টি বুলাবে, লিখা হবে হজ্বের নেকী।

আবার এই চোখে হারামে আরাম খুঁজবে, তৈরি হতে থাকবে উত্তপ্ত গলিত সীসা।

এই চোখের সাথে অন্তরের আজব বন্ধন। চোখের সামান্য দৃষ্টিতে হৃদয়পটে অংকিত হয়ে যায় ছবি, আর তা জেগে থাকে দীর্ঘকাল। আর মাঝে মাঝে সেই ছবি জেগে উঠে মন করে অস্থির।

চোখ ভালো থাকবে, দিল ভালো থাকবে। চোখের দৃষ্টি নষ্ট হবে, দিল হয়ে পড়বে পংকিল, অপবিত্র।

এজন্য আল্লাহ তায়ালা চোখ নীচু রাখার হুকুম দিয়েছেন। পুরুষকেও, নারীকেও। আলাদা আলাদা সম্বোধনে। কারন এই চোখ একবার হারামে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বরবাদ করে ছাড়বে ভেতরের পুরো পৃথিবী।

আল্লাহ তায়ালার হুকুম এমন নয় প্রসারিত করে রাখো, পড়লে না হয় সরিয়ে নিও। বরং একদম নীচু করে রাখো, অপাত্রে পড়তেই দিও না। কারন মাওলা ভালো করেই জানেন, দৃষ্টি একবার পড়ে গেলে তা সংযত করতে পারে এমন বীরপুরুষ বড় অপ্রতুল।

প্রথমবারের দৃষ্টি মূহুর্তেই যখম করে অন্তর। এই ক্ষতের মলম তালাশে নফস দাবী করে আবার তাকানোর। দ্বিতীয় দৃষ্টি ক্ষতকে আরও গভীর করে, প্রশস্ত করে। এই বার নফস চড়াও হয় আগের চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে। অসুস্থ অন্তর তার মুকাবিলা করতে পারে না। সে নিজেকে নফসের হাওয়ালা করে। নফসের লাগামহীন ঘোড়া তাকে নিয়ে কোথায় কোথায় যে ছুটতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। অসুস্থ অন্তর হয়ে পড়ে মুমূর্ষু। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট ছাড়া তখন আর কোন গতি থাকে না।

হজরত হাফেজ্জ্বী হুজুর রহঃ। তাকে আমি দেখি নি। যারা দেখেছেন, তাদের মুখে শুনেছি এক লম্বা জীবন নজরের পবিত্রতা ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ঝুঁকে চলতে চলতে বাঁকা হয়ে গেছে তার ঘাড়। কুরআনের আয়াত তাকে নজর তুলে তাকাতেই যেন দিলো না। এই হচ্ছে আল্লাহর বান্দা।

হজরত গঙ্গুহী রহঃ। দীর্ঘ সতের বছর এক পথ দিয়েই প্রতিদিন দরস দিতে যেতেন। নজরের হিফাজত করতে গিয়ে কোনদিনই দু’পাশে চোখ মেলে তাকান নি। এক লোক একদিন নিজের বাসা চেনাতে হজরতকে বললো, হজরত, আপনার চলার পথেই আমার বাসা। হজরতের ‘কোথায়’ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সে কোনভাবেই হজরতকে চেনাতে সক্ষম হলো না। কিভাবে সে চেনাবে? তিনি যে এই দীর্ঘ সময়ে নজর নীচু করেই চলেছেন। কোনদিন খেয়াল করেন নি ডানে কি, আর বামে কি। অথচ তখন কি আর এখনকার মতো নগ্নতা ছিলো!

আজ আমাদের এই যুগে যেখানে কোন দেয়াল, কোন বিলবোর্ড নগ্নতা থেকে খালি নেই, আমাদের কি করা উচিত!

নজরের হিফাজতের তারগীব শুনলেই আমরা বলি, ‘ কি করে সম্ভব!’ আমরা ধরেই নিয়েছি আজ আর তা সম্ভব নয়। অসম্ভব ধরে নিয়ে আমরা সবাই এক সাথে মরতে বসেছি। পিতা-পুত্র এক সাথে। মা-মেয়ে এক সাথে। শিক্ষক-ছাত্র এক সাথে। কেউ কারোরটা দেখেও দেখে না। ‘হায়া’র সংজ্ঞা আমরা ভুলে গেছি সেই কবে!

শায়খুল হাদীস রহঃ ‘আপবীতি’তে বলেছেন, যৌবনের শুরুতেই এই রোগের উৎপত্তি। যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে এ রোগ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়বে।বুড়ো বয়সেও এ থেকে নিস্তার নেই। তিনি বলেছেন, কত সম্ভাবনাময় লোক, কত মেধাবীজন কেবল এই এক রোগে মাহরুম হয়ে গেছে। তার যোগ্যতা কোন কাজেই আসে নি।

নজরের হিফাজতের সাথে অল্প মেহনত তাকে এগিয়ে নিবে বহুদূর। নজরের খেয়ানতের সাথে হাজার মেহনত কেবলই হতাশা।

তাই শক্ত প্রতিজ্ঞা চাই। প্রকাশ্যেও, গোপনেও।

ছবি আর ভিডিও’র মোড়কে আজ অশ্লীলতার মহামারি। কিছু মানুষরূপী জানোয়ার পরিবেশকে করেছে বিষাক্ত। এদের আকর্ষণীয় চামড়ার আড়ালে এরা প্রচন্ড কুৎসিত। এদের প্রতি অন্তরে ঘৃণার প্লাবন চাই।

আমি কেন আমার সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করবো। রবের লানত সংগে করে কখনো কি  সফল হওয়া যায়!

নজরের হিফাজত করতে গেলে দিল ক্ষতবিক্ষত হবে। মাওলা এ যখমে দয়ার মলমের প্রলেপ দেবেন। রবের একান্ত সান্নিধ্যের অপার্থিব স্বাদ দান করবেন এই দুনিয়াতে। আর টেনে নিয়ে যাবেন বেলায়েতের চূড়ায।

একটা পবিত্র অন্তর নিয়ে যখন কাল কিয়ামতের মাঠে রবের সামনে দাঁড়াবো অভ্যর্থনা আসবে,

ادخلوها بسلام ذلك يوم الخلود.

ঢুকে পড়ো শান্তির সাথে, আজ এখানে অনন্ত জীবন।

 

২০

প্রিয় ভাই, আজ প্রিয় শত্রু নিয়ে বলি। সে প্রিয় শত্রুটি তোমার আমার নফস। তাকে বশে আনতে মুজাহাদার বিকল্প নেই।

একজন ছাত্র পরীক্ষার রাতে দীর্ঘ সময় পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত থাকে কোন আয়োজনে কিংবা বিনোদনে। তারও তাদের সঙ্গ দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে পারে না। সে বই-খাতা নিয়ে পড়ে থাকে। আর সহ্য করে যায় অন্যদের সাথে শরীক হতে না পারার বেদনা। এক সময় রেজাল্ট বের হয়। ভালো রেজাল্টের স্বাদ তার কষ্টগুলো ধুয়ে দেয়।

রোগী অসুস্থতায় কাতরাতে থাকে। সাধারণ পথ্যই হয় তার খাবার। সবাই মজা করে খায়। সে রোগের কারণে খেতে পারে না। কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে। তার খুবই কষ্ট হয়। এক সময় সে সুস্থ হয়ে যায়। সুস্থতার আনন্দ তাকে বঞ্চনার কষ্টগুলো ভুলিয়ে দেয়।

এভাবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মানুষ কষ্ট করে। তাকে কষ্ট সহ্য করতে হয়। কত জিনিস ত্যাগ করতে হয়! যে এভাবে বৃহত্তর স্বার্থে কষ্ট করে যায়, তার জীবনে এক সময় সাফল্যের বসন্ত নামে।

নফসের উল্টো চলা, জোর করে নিজেকে দ্বীনের উপর চালানোর বিষয়টাও এমন। কেবলই নিজের সাথে বুঝাপড়া। মানুষ দুনিয়ার স্বার্থেই তা করে। যদি সুন্দর আখিরাতের জন্যেও সে করতে পারে তবেই তার জীবন অর্থবহ হয়।  ঈমান এই বুঝাপড়াকে সহজ করে দেয়। অরুচির মধ্যেও রুচি তৈরি করে। বিস্বাদের মধ্যেও সৃষ্টি করে স্বাদ। এ জন্যই প্রয়োজন ঈমানের মেহনত এবং ক্রমাগত মুজাহাদার।

মনে করো, তুমি এক মুসাফির। একা পথ চলেছো। তোমার সামনে দুটি পথ। একটি কঠিন, পথ চলতে কষ্ট, পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। অন্যটি মসৃণ, ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে, পথচলা বড় সহজ।

প্রথমটি এবড়ো-থেবড়ো, মাঝে মাঝে খাদ, বড় বড় অমসৃণ পাথর। পথচলা বড় কষ্ট। ভ্রমন সুখকর নয়। কিন্তু তার সামনে একটা ফলক, যা স্থাপন করেছে সরকার। তাতে লিখা- এই রাস্তার শুরুটা অমসৃণ, পথচলা কষ্ট, কিন্তু এটিই সঠিক পথ, যেটি পৌঁছে গেছে বড় শহরে, আকাঙ্খিত গন্তব্যে।

আর দ্বিতীয়টি চলাচলযোগ্য, গাছের ছায়ায় ঢাকা, দু’পাশে ফুল ও ফল। মাঝে মাঝে কফিশপ, তাতে রয়েছে বিনোদনেরও সামগ্রী, যা অন্তরকে মোহিত করে, চোখ তৃপ্তি পায়, কানগুলো সুরের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়। কিন্তু পথের শেষে একটা ফলকের উপর লিখা- সাবধান! এটি খুবই বিপদসংকুল পথ, এর শেষে রয়েছে গভীর গর্ত, যাতে পড়লে সাক্ষাৎ মৃত্যু,  নিশ্চিত ধ্বংস।

এখন কোন পথ তুমি বেছে নেবে?

এতে কোন সন্দেহ নেই, নফস কঠিনটি বাদ দিয়ে সহজটার দিকেই ঝুঁকবে। কষ্টকর পথ ছেড়ে স্বাদযুক্ত পথেই চলতে চাইবে। স্বাধীনতাকে ভালবাসবে, বন্দীত্বকে অপছন্দ করবে। এটিই নফসের স্বভাব, যে স্বভাবের উপর আল্লাহ তায়ালা তাকে সৃষ্টি করেছেন। যদি মানুষ নিজেকে তার মনের উপর সোপর্দ করে, তাহলে নিশ্চিত সে দ্বিতীয় রাস্তাই অবলম্বন করবে। কিন্তু আকল তাতে বাধা দেবে। আকল বর্তমানের সাময়িক আরামকে পরিণতির কঠিন কষ্টের সাথে ওজন করে দেখবে। অল্প সময়ের কষ্ট সত্ত্বেও অনন্তকালের আরামের কথা চিন্তা করে প্রথম রাস্তাকেই প্রাধান্য দেবে।

এটিই উদাহরণ জান্নাত ও জাহান্নামের রাস্তার।

জাহান্নামের রাস্তায় রয়েছে প্রতিটি স্বাদযুক্ত ভোগের সামগ্রী, যেদিকে নফস ধাবিত হয়। মন যেদিকে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়। সেদিকে আছে দেখার তৃপ্তি, নিষিদ্ধ সৌন্দর্যের হাতছানি, সেদিকে আছে ভোগ আর স্বাদের নগ্ন আহবান, যে কোন উপায়ে সম্পদ আহরণের সুযোগ, সেদিকে আছে বল্গাহীন স্বাধীনতা। নফস মুক্ত থাকতে ভালবাসে, বাধাকে অপছন্দ করে।

আর জান্নাতের পথে আছে কষ্ট, কাঠিন্য। সেপথে আছে সীমা এবং শিকল। সেপথে আছে নফসের বিরোধিতা। কিন্তু এই কষ্ট ও অপছন্দের বিনিময়ে আছে অনন্ত স্বাদ।

এখন তুমিই ঠিক করো, তুমি কোন পথে আগাবে!