দৃষ্টির রসায়ন
দৃষ্টির রসায়ন
কতই না অদ্ভূত আমাদের এই চোখ! যখনই চোখের গঠন নিয়ে ভাবি, দৃষ্টির রসায়ন নিয়ে চিন্তা করি, আমার ভেতরটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নুইয়ে আসে।ইচ্ছে করে এক সিজদায় জীবনটা কাটিয়ে দিই।
কী আশ্চর্য গঠনই না আমাদের এই চোখের। চল্লিশের অধিক বৈচিত্রপূর্ণ অংশ নিয়েই এই আঁখিযুগল। এর মধ্যে মাত্র একটির অবস্থাই যদি আমরা বিবেচনা করি, বুঝে আসবে কোন জিনিসের নাম সৃষ্টিকৌশল।
আমাদের চোখের বৈচিত্র্যময় একটি অংশ লেন্স। যে বিষয়টি আমরা কখনোই উপলদ্ধি করি না, এই যে চোখের সামনের প্রতিটি বস্তুকে আমার সুস্পষ্ট দেখা, তা যে এই লেন্সটির অবিরাম স্বয়ংক্রিয় ফোকাসিং এরই ফসল।
চোখের সামনে আমার আঙ্গুলের অগ্রভাগ ধরলাম। এক দৃষ্টিতে তাকালাম আঙ্গুলটির অগ্রভাগে। অতঃপর সেখান থেকে দ্রুত দৃষ্টিকে সরালাম সামনের দেয়ালে। আবার দ্রুত নজর করলাম আঙ্গুলে।দৃষ্টির প্রতিটি পরিবর্তনে আমরা অনুভব করি সুক্ষ্ণ এক দ্রুত এডজাস্টমেন্ট।
লেন্সটি মাইক্রো সেকেন্ডেরও কম সময়ে তার পুরুত্বকে পরিবর্তন করছে। আর লেন্সের পুরুত্বের এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতগুলো পেশি। এরা দ্রুত সংকোচিত ও প্রসারিত হয়ে লেন্সটিকে এডজাস্ট করে নিচ্ছে যেন সামনের বস্তুটি আমার কাছে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। লেন্সটি এভাবে নিজের পুরুত্বকে এডজাস্ট করছে আমাদের জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডে। আর কোন প্রকার ভুল করছে না একবারও।
ফটোগ্রাফার যখন ছবি তোলে, প্রতিবার হাতের মাধ্যমে নিজেদের ক্যামেরার এই এডজাস্ট তারা করে নেয়। কখনো কখনো তাদের সঠিক ফোকাসের জন্য কিছু সময় রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি এমন ক্যামেরা উদ্ভাবন করেছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফোকাসিং করতে পারে। কিন্তু কোন ক্যামেরাই চোখের মতো এত দ্রুত ও এত সঠিকভাবে ফোকাস করতে পারে না।
একটা চোখ কেবল তখনই দেখতে সক্ষম, যখন চল্লিশেরও বেশি অংশ একই সময়ে একসাথে সঠিকভাবে কাজ করে। চোখের লেন্স সেই অংশগুলোর মাত্র একটি।
যখন চোখের প্রতিটি অংশ- কর্নিয়া, আইরিশ, পিউপিল, রেটিনা, অক্ষি-পেশিগুলো সবাই একসাথে সঠিকভাবে কাজ করছে, কিন্তু কেবল আইলিড (নেত্রপল্লব) অনুপস্থিত, তবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে চোখের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে আর সে কাজ করা বন্ধ করে দেবে। সবই ঠিক আছে, কেবল অশ্রু তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো, চোখ শুকিয়ে যাবে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে অন্ধ হয়ে যাবে।
উপরের কথাগুলো সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায়, তার অর্থ হলো, একটা জটিল অঙ্গ, যা অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন অংশের সমন্বয়ে কাজ করে, তার একটিকেও যদি সরিয়ে নেয়া হয়, সেই সিস্টেমটি অকেজো হয়ে পড়বে। এই বিষয়টিকে বায়োকেমিস্ট মাইকেল জে বিহে তার বিখ্যাত বই ” Darwin’s black box: the biochemical challenge to evolution’ ( প্রকাশ ১৯৯৬) এ বর্ণনা করেছেন ‘হ্রাস-অযোগ্য জটিলতা’ নামে।তার এই বই ছিলো ডারউইনবাদের উপর বিশাল আঘাত।
লেন্স, রেটিনা, পিউপিল, কর্ণিয়া ইত্যাদি অনেকগুলো জটিল অঙ্গ কিভাবে একসাথে হঠাৎ করে গঠিত হবে কেবলই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে? কারন প্রাকৃতিক নির্বাচন তো আলাদাভাবে ভিজুয়াল নার্ভ ও রেটিনাকে বেছে নিতে পারে না। ধরে নিলাম হঠাৎ করে লেন্স গঠিত হলো, কিন্তু রেটিনার অনুপস্থিতিতে এর কি অর্থ হবে? কাজেই দেখার জন্যে এই সবগুলো অংশের একসাথে ডেভেলপ করাকে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।